বিশ্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সবচেয়ে রক্তাক্ত
The World's Bloodiest Border-:India- Bangladesh
সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। ডান পায়ে গুলির ক্ষত। রক্তে ভেজা পরনের লুঙ্গি। শরীরের উপরের অংশে কোনো কাপড় নেই। পায়ে গুলি করার পর নির্মমভাবে পিটিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় লোকটিকে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। বুধবার মধ্যরাতে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার আমঝোল সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ার এপাশে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে লাশ ফেলে রেখে যায় বিএসএফ। উন্মত্ত বিএসএফের নির্মমতার এটি সর্বশেষ ঘটনা, তবে নিশ্চিতভাবে শেষ ঘটনা নয়।
বিশ্বের সীমান্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। এই সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত বলে মনে করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখানে গত in last 20 years ২০ বছরে 1,304 Bangladeshis were killed by BSF ১ হাজার ৩০৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার, চীন, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানের স্থল সীমান্ত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তেই সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা অনেকটাই প্রকাশ্য। সেদিক থেকে চিন্তা করলে এই ধরণের হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি ঘটার কথা ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সীমান্তে প্রাণহানিতে বিশ্ব রেকর্ডটি আমাদেরই, আর হতাহতের সবাই না হলেও অন্তত ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেবে, বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে প্রতিবছর গড়ে ৫০ জনের মতো বাংলাদেশি নাগরিক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে নিহত হন। এই দু’দেশের সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা এতই বেশি যে, অনেক মানবাধিকার সংস্থা এই সীমান্তকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসংকূল সীমান্তগুলোর একটি বলেই চিহ্নিত করেছে। আর বিএসএফ-কে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বাহিনী হিসেবেও চিহ্নিত করেছে কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠন যার অর্থ হলো- এই বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে পছন্দ করেন।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার সীমান্ত হত্যা নিয়ে লেখা একটি কলামে উল্লেখ করেন, সীমান্ত শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আছে তাতো না, সব দেশেরই সীমান্ত আছে, প্রতিবেশী আছে, খুঁটিনাটি ঝগড়া আছে। কিছু কিছু সীমান্ত সীমান্তরক্ষীদের নিষ্ঠুরতা ও দমন-পীড়নের জন্য কুখ্যাত। যেমন ফিলিস্তি-ইসরাইল সীমান্ত। কিন্তু সীমান্তে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিন-ইসরাইল নয়, সবচেয়ে মশহুর (পরিচিত) হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বাংলাদেশের নাগরিকদের এখানে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে করতে দিল্লির সৈনিকেরা মারে। আর প্রায়ই বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে এসে তারা কুকুর-বেড়াল ধরার মতো মানুষ ধরে নিয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলও মনে করেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হলো পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্তগুলোর একটি। তার মতে, ভারত যদি বাংলাদেশের বন্ধুই হবে তাহলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রক্তাক্ত হবে কেন, সীমান্তে এত বাংলাদেশীকে হত্যা করবে কেন ভারত? তাও আবার একতরফাভাবে শুধু ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর হাতে বাংলাদেশি নাগরিক মারা যাচ্ছে।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বর্ডারগুলো, এমনকি যে সব বর্ডারে সবসময় যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান, সেখানেও এমন একতরফাভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটছে না। ফিলিস্তিন-ইসরাইল বর্ডারও একটি রক্তাক্ত বর্ডার, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত রক্তাক্ত। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডারের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশের বর্ডারেই এমন নির্বিচারে একতরফা মানুষ হত্যা করা হচ্ছে না।’
যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৪৪তম সীমান্ত সম্মেলনের পর থেকে সীমান্তহত্যা অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ওই সম্মেলনে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যহবহার কমিয়ে সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ।
সীমান্তহত্যা শূন্যেরর কোঠায় নামিয়ে আনতে গবাদি পশু ও মাদক চোরাচালানপ্রবণ এলাকায় সমম্বিত যৌথ টহল, সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের বিধিনিষেধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজিবি ও বিএসএফ কর্তৃক যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন- এই ছয় মাসে বিএসএফ ১০ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে সাতজনকে গুলি করে, একজনকে নির্যাতন করে, একজনকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। আর বিএসএফের ধাওয়া খেয়ে পদ্মা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে একজন মারা যান।
এছাড়া ২৪ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ আহত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজন বিএসএফের গুলিতে, ১০ জন নির্যাতনে, ছয়জন পাথর নিক্ষেপের কারণে এবং তিনজন সাউন্ড গ্রেণেড বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। এই সময়ে বিএসএফ কর্তৃক অপহৃত হন ১৪ জন বাংলাদেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে পাঁচজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ১১ জন ও অপহরণ হয়েছেন ১৯ জন বাংলাদেশি।
অধিকার’র তথ্য অনুযায়ী গত জুন মাসে বিএসএফের গুলিতে চারজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এছাড়া পাঁচজন বিএসএফের নির্যাতনে আহত হয়েছেন। বিএসএফ সদস্যরা দুজন বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত ২০ জুন ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোসালপুরে বিএসএফের গুলিতে সোহেল রানা (১৭) ও হারুন অর রশীদ (১৫) নামে দুজন স্কুলছাত্র নিহত হয়।
গত ২১ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার গিলবাড়ি সীমান্তের ২০১ এর ৫ আর সীমান্ত পিলারের কাছ দিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বিএসএফ। এতে সাইদুল ইসলাম নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত হন আরো আটজন। গরু ব্যবসায়ী সন্দেহে তাদেরকে গুলি করে বিএসএফ।
এক নজরে বিগত ২১ বছরের (১৯৯৬-২০১৬) সীমান্তহত্যা
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও বিবিসির তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ১ হাজার ৩০৪ জন মানুষের প্রাণ গেছে। পরিবর্তন ডটকমের পাঠকদের জন্য নিহতের পুরো পরিসংখ্যানটি তুলে ধরা হলো-
এক. ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন।
দুই. ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন।
তিন. ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন।
চার. ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন।
পাঁচ. ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন।
ছয়. ২০০১ সালে ৯৪ জন।
সাত. ২০০২ সালে ১০৫ জন।
আট. ২০০৩ সালে ৪৩ জন।
নয়. ২০০৪ সালে ১৩৫ জন।
দশ. ২০০৫ সালে ১০৪ জন।
এগার. ২০০৬ সালে ১৪৬ জন।
বার. ২০০৭ সালে ১২০ জন।
তের. ২০০৮ সালে ৬২ জন।
চৌদ্দ. ২০০৯ সালে ৯৬ জন।
পনের. ২০১০ সালে ৭৪ জন।
ষোল. ২০১১ সালে ৩১ জন।
সতের. ২০১২ সালে ৩৮ জন।
আঠার. ২০১৩ সালে ২৯ জন।
ঊনিশ. ২০১৪ সালে ৩৩ জন।
বিশ. ২০১৫ সালে ৪৫ জন। এবং
একুশ. ২০১৬ সালে ৩০ জন।
সবচেয়ে বেশি সীমান্তহত্যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হত্যা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে। তাদের শাসনামলে ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৪ সালে ১৩৫, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫ ও ২০০১ সালে ৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরেই নিহত হয় ৬২৭ জন বাংলাদেশি।
এছাড়া সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মোট ১৮২ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬২ জন এবং ২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হয়। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সীমান্তহত্যা ঘটে ২০০৯ ও ২০১০ সালে।
এক নজরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
ভারত ও বাংলাদেশ চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্তের যৌথ অংশীদার যা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পাঁচটি রাজ্যের (পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম) সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ২ হাজার ২১৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এছাড়া আসামের সাথে ২৬৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার ৮৫৬, মেঘালয়ের ৪৪৩ এবং মিজোরাম রাজ্যের সাথে ৩১৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
এই সীমান্ত প্রসঙ্গে চ্যানেল ফোরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন রাগম্যান এক প্রতিবেদনে বলেছেন, সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যার ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি। সীমান্তে হতাহত ব্যক্তিদের সবাই গরু পাচারকারী অথবা চোরাকারবারি নন। এসব অবৈধ কারবারে কেউ কেউ নিশ্চয়ই জড়িত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ এবং বিপদের শিকার হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক এবং তাদের পরিবারগুলো।
নির্মম সেই হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছিল মানবতাকে
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্ত হয়ে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে প্রাণ হারায় কিশোরী ফেলানী। তার লাশ অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলে থাকে প্রায় ৫ ঘণ্টা। অথচ দেশে ফিরে বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল তার।
কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কড়া প্রতিবাদে বিচারের ব্যবস্থা হলেও ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিএসএফের আদালত আসামি বিএসএফের কনস্টেবেল অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়।
ফেলানীর পরিবারের আপত্তিতে বিএসএফ মহাপরিচালক রায় পুনর্বিবেচনার আদেশ দিলে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নতুন করে শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১৫ সালের ২ জুলাই পুনর্বিচারের রায়ে অমিয় ঘোষকে আবারো নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। সে রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট করা হয়। এ অবস্থায় মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন ফেলানীর বাবা ও মা। (চলবে)
http://www.poriborton.com/poriborton-special/59497
This is the symbol of selfless friendship shown by the Indian's according to the AL diplomats of Bangladesh.