বরাবরের মত জুমা'র নামাজ পড়তে কাঁটাবন মসজিদে গেলাম। মসজিদ ঢোকার আগে দেখি থমথমে অবস্থা। পুরো গেটজুড়ে ও তার আশপাশে অজস্র দাঙ্গা পুলিশ, শুধুমাত্র একজন ঢোকার মত ফাঁকা আছে। এর আগে এরকম দেখেছি শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আর ফৌজদারী আদালতে আসামী হাজির করবার সময়, তাও টিভিতে! পুলিশ মুসল্লিদের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কেউ এইমাত্র খুন করে এসেছে। ভেতরে হাজার হাজার মানুষ, কাঁটাবন মসজিদে মহিলাদেরও নামায পড়ার ব্যবস্থা থাকায় শিশু এবং নারীও প্রচুর।
আজকে এমন অনেক মানুষ মসজিদে ঢোকার আগে নিজের সন্তানের সামনে পুলিশের হাতে নাজেহাল হলেন, যারা কখনও রাজনীতি করেননি, বাচ্চাটি জানেনা কি অপরাধে পুলিশ তার এত্ত ভাল আব্বু'র সাথে এমন ব্যবহার করলো, গায়ে হাত দিলো, আর যিনি ভুক্তোভোগী তিনি সম্ভবত এই ঘটনা বাকি জীবনে ভুলতে পারবেন না! যাদের দাড়ি ছিলো তাদের কথা নাইবা বললাম! ভেতরে ঢুকে দেখি উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় একেকজনের চেহারা চুপসে আছে, অনেকেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন নিচে কি হচ্ছে! কয়েকজনকে দেখলাম গেটের বাইরে পুলিশের হাতেপরা বন্ধুর নাম ধরে কাঁপা গলায় ডাকাডাকি করছে, তাদের ভেতরের টানটা স্পষ্ট টের পেলাম, খুব অল্পসময়ের জন্য হলেও নিজের বন্ধুদের কথা মনে পড়লো। মনে হলো বাইরে কয়েকজন কারারক্ষী আর ভেতরে কারাবন্দী বাংলাদেশ...
ঈমাম সাহেব সালাম ফেরালেন, সেই সাথে মুসল্লিরাও। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো গুলি বৃষ্টি। এর আগেও পুলিশের আক্রমন দেখেছি, কিন্তু আজকে যা দেখলাম সেটা অতীতের সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেলো! মাত্র ১৫ সেকেন্ডেরো কম ব্যবধানে পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটি টিয়ারসেল ছুটে এলো মসজিদের গেটে এবং ভেতরে! ধোয়ায় সাদাটে হয়ে হয়ে গেলো মসজিদের চার তলা পর্যন্ত! বেশিরভাগ মানুষই জীবনে প্রথমবার টিয়ারগ্যাস কি জিনিস জানলেন, এও জানলেন ব্রাশফায়ারের শব্দ আসলেই কেমন হয়! ভয়ে এদিক সেদিক ছুটতে থাকা মানুষগুলোর চোখ ঝাঝে এতটাই লাল হয়ে গেলো দেখে মনে হলো রক্ত ঝরছে! নিজের চোখ দিয়েও দরদর করে পানি ঝরছে, চামড়ার জ্বলুনীও টের পেলাম। নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেলাম যখন ছোটছোট বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালাম!
'আব্বু আমার চোখ জ্বলছে, আমাকে বাসায় নিয়ে চলো, আমি আম্মুর কাছে যাবো!" ... অসহার বাবা আরও শক্ত করে ধরলেন সন্তানের হাত! মোবাইলে ফোন এলো, বাচ্চার মা ফোন দিয়েছে, টিভিতে নাকি দেখেছেন কাঁটাবনে খুব গোলাগুলি হচ্ছে! স্ত্রীকে কিভাবে বোঝালেন জানিনা কিন্তু তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে দেখলাম। এ পানি টিয়ার গ্যাসের কারনে নাকি বাবা হিসেবে সন্তানের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার বেদনায় আমি জানিনা...
আমার সামনে দাঁড়ানো নীল পাঞ্জাবীপরা ছেলেটা কপালে গুলি খেয়ে পরে গেলো, তাকিয়ে দেখি বাচ্চা ছেলে! কতো আর হবে বয়স, পনের কি ষোল! রক্তে ভেসে গেলো আল্লাহর ঘর!!! এরপর আরও দু'জন, একজনের বাম হাতে। তবে রাবার বুলেট হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যাবে ইনশাল্লাহ! একজন ছুটে এলো আমার কাছে, অপরিচিত, ভাই পানি হবে! মাথা নাড়লাম, মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না ...
জানি বের হলে এরেস্ট হতে পারি, গুলি খাবার সম্ভাবনাও প্রচুর, কিন্তু বিদ্রোহ করে উঠলো সমগ্র সত্তা! বের হয়ে গেলাম মসজিদ থেকে, আমি একা নই, আরও অনেকেই আছেন!
যখন বাসায় ফিরছি দেখি ছোট ভাই আমার খোজে বের হচ্ছে, বললো ফোন ধরোনি কেন? মোবাইল বের করে দেখি অসংখ্য মিসড কল! যে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এলাম মোবাইলের ভাইব্রেশন টের পাবার কথা না...