Written by a patriotic Bangladeshi:
???? ???? ??????
কারা বেশি বিপন্ন
স ঞ্জী ব চৌ ধু রী
মন ভালো নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকার হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকান-পাট আর মন্দিরের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে যে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল, তা এখনও পুরোপুরি থামেনি। না থামার দু’টি কারণ আমার চোখে ধরা পড়েছে। প্রথমত, বিভিন্ন এলাকার দুর্বৃত্তরা এটাকে একটা মজার খেলা হিসেবে পেয়ে গেছে। তারা ভাবছে, এভাবে উত্ত্যক্ত করে হিন্দুদের যদি ভিটেছাড়া করা যায়, তবে তাদের বাড়িটা অথবা দোকানটা অথবা মন্দিরটা বিনামূল্যে কিংবা পানির দরে নিজের করে নেওয়া যাবে। তা যদি নাও যায়, লুটপাটে যা পাওয়া গেল, সেটাই নগদ লাভ। লুটের মাল বেচে এক দিনের বা কয়েক দিনের নেশার খরচ মেটানো যাবে! এই ছিঁচকে হামলাগুলো হতো না, যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আন্তরিক, সজাগ ও সক্রিয় থাকত। সরকার হাঙ্গামাগুলো থামানোর ব্যবস্থা করার পরিবর্তে এসবের পেছনে যে জামায়াত-শিবির আর বিএনপি জড়িত, সেটা প্রমাণের চেষ্টায় আদাজল খেয়ে নেমেছে। এটাই সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন স্থাপনায় থেমে থেমে হামলার দ্বিতীয় ও প্রধান কারণ। এবারের এসব হামলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে না, নারীত্বের লাঞ্ছনারও খবর পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় বড় ধরনের হামলা না হওয়ায় মিডিয়ায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হচ্ছে না। ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ নিয়ে সামাজিক আলোড়ন যতটা হওয়ার কথা ছিল, তাও অনুপস্থিত। তবে কেউ যদি এসব হামলা থেকে রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক ফায়দা নিতে চায়, তার সুযোগ ষোলো আনা থেকে যাচ্ছে। ২৫ দিন অথবা ৩০ দিনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অঘটনের বিবরণ একত্র করে তার সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা বাড়ি অথবা মন্দির এবং কয়েকটি ভাঙা মূর্তির ছবি যদি জুড়ে দেয়া যায়, তবে এই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পেশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চোখ ছানাবড়া করে দেয়া সম্ভব।
আরও একটা ব্যাপার আছে। আমাদের দেশের মতো ভারতেও জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। ভোটের রাজনীতি সে দেশে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, এই তত্ত্ব যদি ভারতের হিন্দু ভোটারদের গেলানো যায়, তবে ভোটের প্রয়োজনে যারা হিন্দুত্ববাদী সেজে অতীতে লাভবান হয়েছে, তাদের সুবিধা। এই সুবিধা চেটেপুটে আদায় করে নেয়ার জন্যই ত্রিপুরা থেকে বিজেপির পক্ষ থেকে হুঙ্কার শোনা গিয়েছিল, বাংলাদেশে ‘বিপন্ন হিন্দুদের রক্ষা’র জন্য তারা আগরতলা থেকে হাজারে হাজারে ঢাকার দিকে ধেয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত তাদের হুঙ্কার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। তবে এদের পক্ষ থেকে ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশী হিন্দুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের বিরাম নেই। এই প্রচার চলতেই থাকবে ভোটের আগ পর্যন্ত, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে ভোটের বাক্স ভরার প্রয়োজনে।
এদিকে সে দেশে হিন্দুত্ববাদীদের বিপরীত পক্ষ ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা শাহবাগের ‘গণজাগরণ’কে একেবারে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছেন। যদিও বিপ্লব-পরবর্তী গিলোটিনের কোপ কার গর্দানে পড়বে, সে ব্যাপারটা তাদের মিডিয়া ক্যাম্পেইনে স্পষ্ট নয়।
এসব খেলা খেলতে গিয়ে ‘বিচ্ছিন্ন’ হামলায় সর্বস্বান্ত হওয়া হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ যে দু-চারজন বিপন্ন হিন্দুদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, তারাও নাকি ‘মানুষ’ নন। তারা সবাই জামায়াত-শিবিরের ‘মৌলবাদী দানব’!
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে হিন্দুরা যে নিজেদের বিপন্ন মনে করছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কথা হচ্ছে, দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে কি শুধু হিন্দুরাই বিপন্ন? আদি নিবাস কুষ্টিয়া, এখন ঢাকার মিরপুরে থাকে, এমন একজন মুসলমান ছাত্র মাঝেমধ্যে আমার দেশ অফিসে আসে। তার গোটা দুয়েক লেখা আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বেশ ফুটফুটে চেহারা। শখ করে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছে। সর্বশেষ যেদিন সে অফিসে এলো, দেখি তার গালে দাড়ি নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দাড়িসহ ধরা পড়ে যেন ‘শিবির’ হিসেবে পিটুনি খেতে না হয়, তার জন্য গাল থেকে দাড়ি নির্মূলের ব্যবস্থা। কুমিল্লা বাড়ি, এখন ঢাকায় থাকে, এমন এক মুসলমান ছাত্রের গানের গলা ভারি চমত্কার। সেও মাঝেমধ্যে আমার দেশ অফিসে আসে। শ্যামলা রঙের ছোটখাটো মিষ্টি ছেলেটি পোশাক-আশাকে পরিপাটি; থুতনিতে আধুনিক পোশাকের সঙ্গে মানানসই দাড়ি। তার দাড়ি আবার এতই ছোট করে ছাঁটা যে, এটাকে ফ্রেঞ্চকাট স্টাইল বলারও জো নেই। সেও দেখি দাড়ি কামিয়ে ফেলেছে। ভাবখানা এমন, দাড়ি যাক; আমি তো বাঁচি! আমার পরিচিত উঠতি বয়সী মুসলমান ছেলেদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন কয়েক দিনের মধ্যে দাড়ি কামিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়েছে প্রাণের দায়ে। এ তো গেল বাইরের কথা, আমার একমাত্র ছেলে বেশ কয়েক মাস হয় শখ করে দাড়ি রেখেছে। তার মা বকাবকি করে, আমি মেজাজ খারাপ করি, কিছুতেই খোঁচা খোঁচা দাড়ির প্রতি তার প্রেম কমে না। কয়েক দিন আগে বাসায় গিয়ে দেখি নিটোল দাড়ি কামানো চেহারা নিয়ে ছেলে আমাকে দরজা খুলে দিচ্ছে। বুঝলাম, সে ‘বিশ্বজিত্’ হতে চাইছে না। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগাশ্রিত একরকম আচরণ দেখা যায়, যাতে তার ধর্মীয় পরিচয় ধরা পড়ে। প্রচুর মুসলমান পুরুষ দাড়ি রাখেন না। মুসলমানের মধ্যে এরাই সম্ভবত সংখ্যায় বেশি। তবে একজন মুসলমান একবার দাড়ি রাখলে তিনি আমৃত্যু দাড়ি রেখে দেন। কখনও ক্লিন শেভড হওয়ার চিন্তা মাথায় আনেন না। বিশেষ করে যারা মাঝবয়সী বা যাদের বয়স তার চেয়ে বেশি, তেমন মুসলমান সম্মানহানি এমনকি জীবনহানির ঝুঁকি নেন। তবু নিরুপদ্রব থাকার জন্য দাড়ি কামিয়ে ফেলার কথা ভাবেন না। আমার অনুজপ্রতিম তেমন এক মুসলমান বন্ধু একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এটাই একমাত্র আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার সদর দফতর ঢাকায়। আমার বন্ধুটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তার অফিসের পরিচয়পত্রটি সঙ্গে রাখেন। বাসা থেকে অফিসে যান, অফিস থেকে বাসায় ফেরেন, আর কোথাও যান না। এমনকি বাজার করার কাজটাও ছেলেকে দিয়ে সারেন।
অনেকে বলতে পারেন, দাড়ি রাখলে বা টুপি মাথায় দিলে বাংলাদেশে মুসলমানদের বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে, এমন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়া আসলে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মতে, উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে হয়তো দাড়ি-টুপি নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এমন অস্বস্তির কোনো কারণ নেই। আমার অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। কয়েক বছর আগের কথা, সেদিন বিকেলের পরিস্থিতি ছিল এখনকার তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়েও শান্ত। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানাধীন নানুপুর মাদরাসার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ওই মাদরাসার তত্কালীন মহাপরিচালক জমিরউদ্দিন হুজুর (বছর দেড়েক আগে ইন্তেকাল করেছেন
আমাকে নিজের ছেলের মতো জানতেন। তার ছেলেদের সঙ্গে আমার বড় ভাই-ছোট ভাই সম্পর্ক। তার ছেলে মাওলানা ফরিদ একজন যুবক হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে হাজির। তারা গুলশানে এক আইনজীবীর চেম্বারে যাবে, আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে। সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা ভাড়া করে আমরা রওনা হলাম। আমাদের বাহন তেজগাঁও পেরিয়ে লিংক রোড ধরে গুলশানের দিকে কিছু দূর এগোতেই অস্থায়ী চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের হস্তক্ষেপে থামতে হলো। আমরা তিনজন নামলাম। ফরিদ আর তার বন্ধু, দুই হুজুরের সঙ্গে আবার একটি করে থলে। পুলিশের সন্দেহ বেড়ে গেল। আমার দিকে কারও নজর নেই। তাদের দু’জনকে তন্নতন্ন করে বারবার তল্লাশি করা হলো প্রায় ২০ মিনিট ধরে। শেষ পর্যন্ত সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায় আমরা ছাড়া পেলাম।
মুসলমান-অধ্যুষিত দেশে দুই ধর্মপ্রাণ মুসলমান যে মুসলমান পুলিশের হাতে হেনস্তা হলেন এবং হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও আমাকে যে কোনো ঝামেলায় পড়তে হলো না, তার কারণ, তাদের টুপি-দাড়ি এবং আমার সাহেবি পোশাক। শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যদি টুপি-দাড়ির এমন বিপদ হয়, তবে এখনকার ফুটন্ত পরিস্থিতিতে কী দশা হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
লেখাপড়ায় তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও আমার ছেলে কথা বলে মহা পণ্ডিতের মতো। তার পাণ্ডিত্য জাহিরের সবচেয়ে সহজ টার্গেট হচ্ছি আমি। দাড়ি কামিয়ে ‘সভ্য’ হওয়ার পর কয়েক দিন আগে এক রাতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল—আচ্ছা বাবা, পরিস্থিতি যদি আমাদের জন্য ভয়াবহ রকমের খরাপ হয়ে ওঠে, তবে আমরা (সে বোঝাতে চেয়েছে হিন্দুরা
না হয় হ্যাচোড়পাচোড় করে কোনো রকমে ভারতে পালিয়ে গেলাম। কিন্তু আজিজ কাকা, সালাম কাকা, ফরিদ কাকা—তাদের কী হবে! আমার ছেলে যে তিন কাকার নাম উল্লেখ করেছিল, তাদের দাড়ি আছে, তারা টুপি মাথায় দেন এবং নিয়ম মেনে নামাজ-রোজা ইত্যাদি করেন। আজিজ কাকা অর্থাত্ কাজী আজিজুল হক আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভিত শক্তিশালী করার জন্য নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। এই সরকারের আমলে প্রথম দিকে তাকে ‘সন্দেহবশত’ আটক করা হয়েছিল। রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। পরে ছাড়া পেয়েছেন। আমার ছেলের সালাম কাকা অর্থাত্ মাওলানা আবদুস সালাম আফগান রণাঙ্গনে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন সে দেশটিকে বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে। অবশ্যই সে যুদ্ধে তার সহায় ছিল ধর্ম। দেশে ফিরে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে পা বাড়ান। পল্টন ময়দানে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সমাবেশ করার লক্ষ্যে সক্রিয় হওয়ার ১৪-১৫ দিনের মাথায় তাকে ‘মহা জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। এখন তিনি অনেক অভিযোগ মাথায় নিয়ে জেলে বন্দী। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অভিযোগুলো সত্য নয়। আমি মাওলানা সালামকে মায়ের পেটের ছোট ভাইয়ের মতো জানি। আমার ছেলের ফরিদ কাকা অর্থাত্ শেখ ফরিদও নানান অভিযোগ মাথায় নিয়ে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন। তিনিও আফগান রণাঙ্গনের এক সাহসী যোদ্ধা। মিডিয়ার একটি অংশ একসময় তাকে ভয়ঙ্কর দৈত্য হিসেবে তুলে ধরেছিল। অথচ আমি জীবনে যে ক’জন নরম মনের মানুষ দেখেছি, শেখ ফরিদ তাদের অন্যতম। ফরিদের মতো ছোট ভাই যে কোনো বড় ভাইয়ের অহঙ্কার।
যা-ই হোক, ছেলেকে বললাম, তোর কাকারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আল্লাহর প্রতি তাদের বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। আল্লাহ অবশ্যই তাদের দেখবেন। ছেলেকে এসব কথা বলে বুঝ দিলাম বটে,
কিন্তু মনে মনে ভাবছি, আজকের বাংলাদেশে কারা বেশি বিপন্ন—আমরা হিন্দুরা, নাকি দাড়ি-টুপি পরা মুসলমানরা? আমি হিন্দু হয়েও নিজের সাহেবি পোশাকের জন্য অচেনা জায়গায় উতরে যেতে পারি। কিন্তু একজন দাড়ি-টুপিধারী মুসলমান ডানে ঘুরলে বলে বেটা জঙ্গি, বাঁয়ে ফিরলে বলে বেটা মৌলবাদী, সামনে এগোতে চাইলে বলে বেটা রাজাকার। তাহলে এরা যাবে কোথায়?