কবুতর: বাংলাদেশে বাড়ছে দামী জাতের পালন, হচ্ছে কবুতরের রেসিং, রয়েছে কবুতরের খামার
Updated: Fri, Sep 17, 2021, 17:28 [IST]By BBC News বাংলা Getty Images
ঢাকার একটি বাজারে বিক্রির জন্য আনা কবুতর বাংলাদেশে বাড়ছে শখের কবুতর পালন এবং এই শখ পূরণ করতে মানুষ এক জোড়া কবুতরের পেছনেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছেন। এসব শখের কবুতরের কোনটি দেখতে সুন্দর, কোনটি অনেক উঁচুতে উড়তে পারে আবার কোনটি রেসিং করে শত শত কিলোমিটার পথ। আর এই কবুতরেরই কোন কোনটির দাম কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হাঁকা হচ্ছে, কেনা-বেচাও হচ্ছে বিস্তর। জানা গেল, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফের নাফ নদী এলাকায় কবুতরের এক রেসিংয়ে অংশ নিয়েছে ৪১২টি কবুতর, যেগুলো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিল।
বাংলাদেশ রেসিং পিজিয়ন ফেন্সিয়ার্স ক্লাবের আয়োজনে ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হয়েছে ক্লাবটির সদস্য মোহাম্মদ রাহাতুল ইসলামের একটি কবুতর, যেটি ৩৩৭ দশমিক ০৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তার ঢাকার মগবাজারের বাজায় ফিরে আসতে সময় নেয় ৪ ঘণ্টা ২১ মিনিট ২ সেকেন্ড। মিস্টার ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে হোমার জাতের এ কবুতরটিকে রেসিংয়ের জন্য তৈরি করেছেন তিনি এবং এ ধরণের প্রায় দুইশো' কবুতরের মালিক তিনি। আর এগুলোর দাম পাঁচ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। কবুতরের ওড়ার প্রতিযোগিতা হলো রেসিং এবং যেসব কবুতর এ ধরণের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, কবুতর-প্রেমীরা তাদেরকে রেসার বলে চিহ্নিত করেন। কবুতর নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, রেসারের উপযুক্ত ভালো একটি হোমার জাতের কবুতর তার আড়াই মাস বয়সে একশো' কিলোমিটার দুরে নিয়ে ছাড়লেও ঠিক উড়ে বাড়ি চলে আসবে।
ঢাকার আকাশে কবুতর রেসার কবুতর কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ছাড়লে যেটি বাড়ি বা নিজ ঠিকানায় ফিরে আসতে পারে, সেগুলোই আসলে রেসিংয়ের জন্য উপযুক্ত বা রেসার হিসেবে সফল হতে পারে। আর এমন যোগ্যতা নিয়ে যেসব কবুতর রেসে অংশ নেয়, সেটাই রেসার কবুতর। অনেকগুলো জাতের রেসার কবুতর রয়েছে, তবে সব জাত দিয়ে রেসার হয় না। হোমার কবুতর রেসার হিসেবে জনপ্রিয়। কারণ হিসেবে যেসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয় তাহলো - চোখের চারপাশে ঘের না থাকা, পায়ের নখ বড় ও বাকা হওয়া, ঠোঁট বাকা হওয়া, ঠোটের বাকানো অংশ থেকে মাথার কোনা পর্যন্ত সমতল হওয়া ইত্যাদি।
দুটি হোমার পাশাপাশি ছাড়া হলে এরা নিজেরাই পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজ ঠিকানায় ফেরত আসতে পারে। রাহাতুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশেও অনেকে রেসার কবুতর পালন বা পরিচর্যা করছেন এবং নিয়মিত রেসিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। Getty Images কবুতর পালন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় কবুতরের তিন ক্যাটাগরি, দুই জাত আর শত প্রজাতি বাংলাদেশে কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, পৃথিবীতে মোটি ১২০ প্রজাতির কবুতর আছে এবং এর মধ্যে বাংলাদেশে আছে ২০ প্রজাতির।
কবুতরের মূলত দুইটি জাত বা ধরণ:
১. স্কোয়াব বা মাংস উৎপাদন জাত
২. চিত্তবিনোদন জাত সাধারণত বাংলাদেশে মাংস খাওয়ার জন্যই বাসাবাড়িতে কবুতর পালন করেন অনেকে, আবার অনেকের খামারও আছে এ ধরণের কবুতরের।
খামারিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কবুতর বা এর মাংস বিক্রি করেন।
অন্যদিকে চিত্তবিনোদন জাতের মধ্যেই আছে আবার কয়েকটি ক্যাটাগরি। যারা শখে লালন পালন করেন, তাদের কাছে এগুলো বেশি সমাদৃত। ন্যাশনাল পিজিয়ন অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ বা এনপিএবি-র জয়েন্ট সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন ফয়সাল জানালেন যে শখের কবুতরের আবার তিন মূল ক্যাটাগরি রয়েছে।
১. ফেন্সি বা দেখতে সুন্দর
২. হাইফ্লাইয়ার বা যেগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ওড়ে
৩. রেসার - যেগুলো জাত ভেদে ৫০ থেকে ১২ কিলোমিটার বা তার বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকানায় ফিরে আসতে পারে
মিস্টার হোসেন বলেন, দেখতে অসাধারণ সুন্দর অনেক কবুতর বিদেশ থেকে আনা হয়েছে যেগুলোর মূল্য কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। "বাংলাদেশে এ মূহুর্তে প্রায় দশ হাজার ফেন্সি কবুতরের খামার আছে। অনেকে নানা দেশ থেকে কবুতর নিয়ে আসছেন। আমি নিজে পশ্চিম আফ্রিকার মালি থেকে ফ্রেঞ্চ মুন্ডিয়ান কবুতর এনেছি, যার মূল্য প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলার," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কয়েকটি দামী কবুতর ন্যাশনাল পিজিয়ন অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের তথ্য বলছে, দেশের বাজারে বেশ কিছু ভালো জাতের কবুতরের এমনিতেই বেশ চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো গিরিবাজ কবুতর। আকাশে ডিগবাজি খাওয়া কিংবা সোজা অনেক দূর আকাশে ওঠার জন্য এটি পরিচিত। এর বাইরে ম্যাগপাই, বুডারবল, সিলভার সিরাজী, লাল সিরাজী জাতের কবুতরও শৌখিন পালকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এসব কবুতর দুই থেকে দশ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। Getty Images কবুতর বাজার আট লাখ টাকার ভিক্টোরিয়া ক্রাউন, আর দামী যেসব কবুতর:
১. ভিক্টোরিয়া ক্রাউন - আকারে প্রায় ময়ূরের মতো লম্বা এ কবুতর এখন বাংলাদেশে কয়েকজন খামারি লালন-পালন করছেন। এগুলোর এক জোড়ার দাম সাড়ে আট লাখ টাকা। ইসমাইল হোসেন ফয়সাল বলছেন, এক বছরে চারবার একটি করে ডিম দেয় এ কবুতর। এ কবুতরটির উৎসস্থল মূলত অস্ট্রেলিয়া।
২. মুন্ডিয়ান - দেখতে দারুণ সুন্দর ফরাসি জাতের এ কবুতরটি পাওয়া যায় পশ্চিম আফ্রিকা আর ফ্রান্সে। ইসমাইল হোসেন ফয়সাল জানালেন যে এগুলোর এক জোড়া তিনি এনেছেন মালি থেকে। মুন্ডিয়ান কবুতরের দাম নির্ভর করে এর রংয়ের ওপর। ভালো জাতের মুন্ডিয়ানের দাম পড়ে তিন হাজার মার্কিন ডলারের মতো। এক একটি কবুতর এক কেজির মতো হয়। বাচ্চা হওয়ার পর দেড় মাসের মধ্যেই আবার ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয়।
৩. নিকোবার - খুবই বিরল এক কবুতরটির আদি বাড়ি আন্দামান-নিকোবর দ্বীপ। ভালো জাতের এই কবুতরের জোড়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। আরব দেশগুলোতে এটা এখন ব্যাপকভাবে ব্রিড করা হচ্ছে।
৪. জ্যাকবিন - বিশ্বের পুরনো প্রজাতির কবুতরগুলোর মধ্যে জ্যাকবিন একটি। দৃষ্টিনন্দন এই কবুতরটি সাধারণ কবুতরের মতোই, কিন্তু মাথায় হুড আছে বলে খুব সুন্দর দেখায়। চোখমুখ ঢেকে থাকে। এরা উড়তে পছন্দ করে না। মান ভেদে এই প্রজাতির কবুতরের দাম হয় ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।
৫. ফেন্টেল - সাধারণ কবুতরের মতো হলেও এর বৈশিষ্ট্য হলো এটি ময়ূরের মতো পেখম মেলে থাকে। জোড়া প্রতি দাম হতে পারে দশ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত।
আরও আছে বাংলাদেশের মক্ষী বাংলাদেশের কবুতরপ্রেমীদের কাছে এই কবুতরের পরিচিতি মক্ষী নামে। টাঙ্গাইলে পাওয়া যায় এমন একটি জাত এটি, যাকে বাংলাদেশের নিজস্ব কবুতর হিসেব দাবি করেন অনেকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিড হয়ে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে আসার পর এর চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে বলে জানা গেল। কবুতর পালকদের নানা ক্লাব থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ জাতের কবুতর এখন তিন হাজার থেকে শুরু করে এর দাম ওঠে লাখ টাকা পর্যন্ত।
কবুতরের গড় দাম শখের ও বাণিজ্যিক খামারিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, চলতি বছর 'লঙ ফেস' প্রজাতির কবুতর সর্বোচ্চ ১৫ হাজার, সিরাজী সর্বোচ্চ তিন হাজার, লাহোরী সিরাজী সর্বোচ্চ ৫ হাজার এবং চীলা সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশে।
এছাড়া, বিউটি হোমা সর্বোচ্চ তিন হাজার, বুদাপেস্ট সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার এবং গিরিবাজ ৬/৭শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে কবুতর বাজারগুলোতে। ঢাকায় কাপ্তানবাজার, টঙ্গীর কবুতরহাট এবং মিরপুর কবুতর হাট কবুতর বেচাকিনির জন্য বেশ প্রসিদ্ধ।