মতিঝিলের গণহত্যা ও ভবিষ্যত্ রাজনীতি
অ লি উ ল্লা হ নো মা ন
বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। রাষ্ট্রীয় টাকায় পোষা পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর
দিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করেছে সরকার। রাষ্ট্রীয় টাকায় লালিত এই বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের ওপর। তাদের সঙ্গে রয়েছে আওয়ামী অস্ত্রবাজ গুণ্ডারা। ইউ টিউবে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে একজন বলেছেন, রাতে মোবাইল দিয়ে ফটো তুলছিলেন এমন কয়েকজনকেও হত্যা করা হয়েছে। হেফজাতের অবস্থান কর্মসূচিতে দিনের ক্লান্তি নিয়ে অনেকেই রাজপথে ঘুমাচ্ছিলেন। এই ঘুমন্ত মানুষের ওপর চালানো হয়েছে ব্রাশফায়ার। যারা রাস্তায় অবস্থানের নিরাপত্তার জন্য সামনে ছিলেন, ব্রাশফায়ার করে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। সামনের সারির কেউ বেঁচে নেই।
গত রোববার হেফাজতে ইসলামের পূর্ব ঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে দিনের বেলায় পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং জনগণের টাকায় লালিত পুলিশ আর র্যাব। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ। এখানে হেফাজতের এক কর্মীকে আওয়ামী লীগ পিটিয়ে হত্যা করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া হেফাজত কর্মীর দেহে আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী লাঠি দিয়ে পেটানোর দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ছবি-ই কথা বলছে সেখানে কী ঘটেছিল। এখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
এই ঘটনায় উস্কানি দিয়েছে একশ্রেণীর আওয়ামী ইলেকট্রনিক মিডিয়া। রোববার দুপুরে বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান (বর্তমান সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা
সময় টেলিভিশনে সম্প্রচার দেখছিলাম। জাগো বিডি নামের একটি ওয়েবসাইটের কল্যাণে বাংলাদেশের সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় বসে দেখার সুযোগ রয়েছে। টেলিভিশনটির রিপোর্টার গুলিস্তানের এই ঘটনা বর্ণনা করার সময় বলছিলেন, হেফাজতের কর্মসূচি প্রতিহত করতে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাধারণ নাগরিকরাও। তখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল, পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অস্ত্রবাজ গুণ্ডা বাহিনীর হাতে লাঠি। এই মিডিয়াগুলোর চোখে আওয়ামী অস্ত্রবাজরা হলো সাধারণ নাগরিক! বাকি যারা রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ ছিলেন তারা সাধারণ নাগরিক নন! এসব দলবাজ মিডিয়ার চোখে হেফজাতের কর্মীরা যেন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী! আর অস্ত্রবাজ আওয়ামীরাই হলো সাধারণ নাগরিক!
গুলিস্তানে আওয়ামী গুণ্ডাদের (সময় টেলিভিশনের চোখে সাধারণ নাগরিক
আক্রমণ দিয়ে তাণ্ডবের শুরু। সময় টেলিভিশনের মতো একই সুরে ৭১ টিভি চ্যানেল, চ্যানেল ২৪ একই বর্ণনা দিচ্ছিল। অর্থাত্ হেফাজত কর্মীদের ওপর সব দোষ চাপানোর জন্য মরিয়া ছিল এই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো। তাতে তারা পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের কিছু দৃশ্য তখন দেখাচ্ছিল। এটা হচ্ছে বাংলাদেশ সময় বেলা ২টার ঘটনা।
আওয়ামী গুণ্ডাদের আক্রমণের মুখে হেফাজত কর্মীরাও তখন নিজেদের রক্ষার চেষ্টায় মরিয়া। পুলিশ ও র্যাব আওয়ামী গুণ্ডাদের রক্ষার জন্য হেফাজতের মিছিলে গুলি চালায়। তাতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকাজুড়ে। এই এলাকায় আওয়ামী গুণ্ডা ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ১৬ জন শাহাদাতবরণ করেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকিদের লাশ পাওয়া যায়নি। এই এলাকাটুকু ছাড়া হেফাজতের বাকি সারা দেশের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। এই হত্যকাণ্ডের ঘটনায় মতিঝিলে হেফাজতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যখন লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় তখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের লাশ দেখার পরও পাল্টা আক্রমণের জন্য মতিঝিল থেকে কেউ পল্টন, গুলিস্তান বা বায়তুল মোকাররমের দিকে রওনা দেয়নি। সমাবেশের মঞ্চ থেকে নেতারা ঘোষণা করছিলেন শান্ত থাকার জন্য। নেতাদের ঘোষণায় উপস্থিত সবাই ধৈর্যের পরিচয় দেন। সেদিন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই হেফাজতে ইসলামকে রাজপথে অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। হেফজাতে ইসলাম শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মতিঝিলে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য। যদিও শাহবাগে অবস্থান নেয়া নাস্তিকদের জনগণের টাকায় লালিত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্তরে-স্তরে নিরাপত্তা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। একটানা তিন মাস শাহবাগে অবস্থান করেছে নাস্তিকরা। নিরাপত্তা দিয়েছে সরকার। ইসলামবিদ্বেষী এই নাস্তিকদের দ্বারা আল্লাহ ও রাসুলকে (সা.) নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদেই হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন। নাস্তিকদের দিনের পর দিন নিরাপত্তা দিয়ে, খাবার সরবরাহ করে, টাকা বিলিয়ে অবস্থানে উত্সাহিত করেছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। উস্কানি দিয়েছে আওয়ামী ও বামপন্থী মিডিয়াগুলো। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোর প্রচারণা দেখলে তখন মনে হতো, বাংলাদেশে আর কোনো মানুষ ঘরে বসে নেই। সবাই শাহবাগে চলে এসেছে।
অপরদিকে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানকে সরকার একদিনও সহ্য করেনি। বেসরকারি টেলিভিশনওয়ালারা শাহবাগের সিকিভাগও প্রচার করেনি হেফাজতের সমাবেশ। বরং সমাবেশ ও অবরোধের কারণে মানুষের যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছিল সেই বিষয় ফলাও করে প্রচার চালানোর চেষ্টা করেছে। আগুন কে বা কারা দিয়েছে সেটা অনুসন্ধানের আগেই হেফাজতের কর্মীদের দায়ী করে রাস্তা থেকে ধারাভাষ্য দেন রিপোর্টাররা।
রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে ১০ হাজারের বেশি বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী গুলি চালায় মতিঝিলে। সেখান থেকে আগেই সরিয়ে দেয়া হয় মিডিয়া কর্মীদের। রাতে বন্ধ করে দেয়া হয় দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি চ্যানেল। এই অভিযানে মতিঝিলে কত লোক হতাহত হয়েছে কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। হতাহতের শিকার লাশগুলোরই বা কী হয়েছে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। লাশ নিয়ে নানা গুজব রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে ঢাকায় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতে মতিঝিলে যৌথ বাহিনীর গুলিতে কয়েকশ’ লোক শাহাদাত বরণ করেছেন। রাত সাড়ে ৩টায় যখন অপারেশন চলছিল তখন একজন ফটো সাংবাদিকের সঙ্গে আমার মোবাইলে কথা হয়। তার কাছে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাওয়া মাত্র বলেন—গুলির আওয়াজে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, আপনি গুলির শব্দ শোনেন। তখন মোবাইলে অপর প্রান্ত থেকে ঝড়ের মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ওই ফটো সাংবাদিক তখন মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের এক দেয়ালের পাশে শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন। সকালে ইমেইলে রাজপথে পড়ে থাকা কিছু লাশের ছবি পাটিয়েছেন তিনি। রাজপথে সেদিন গণহত্যা চালিয়ে কত লোকের প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে সেটার হিসাব পেতে হয়তোবা কিছুটা সময় লাগবে। তবে একদিন এর সঠিক হিসাব বের হয়ে আসবে। এরই মধ্যে হংকং ভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইট্্স কমিশনের তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়াই হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শত শত লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে জনগণের টাকায় কেনা বুলেট।
৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শেষে রাতে যারা মতিঝিলে অবস্থান করছিলেন তারা সবাই ছিলেন নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষ। তারা কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন না বা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিও তারা কোনো দিন করেন না। এই নিরীহ মানুষগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ইজ্জত রক্ষার দাবিতে এখানে সমবেত হয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে জালিমদের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের লাশ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটাও পরিবার জানতে পারবে না।
আল্লামা আহমদ শফীর আহ্বানে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে প্রতিটি পয়েন্টে ছিল লাখো জনতা। তবে রাজপথে অনুপস্থিত ছিল আগামীতে সরকারে যেতে মরিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি
। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে বিকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন মূখপাত্র শামসুজ্জামান দুদু। সংবাদ সম্মেলনে তিনি দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন হেফাজত কর্মীদের পাশে থাকার জন্য। ঢাকায় অবস্থান নেয়া হেফাজত কর্মীদের মুসাফির হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপির মুখপাত্র শামসুজ্জামান দুদু সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বান পৌঁছে দেন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে। তারপরও ঢাকা মহানগর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতের অবস্থানের সঙ্গে ছিল বলে দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়েনি। আনুষ্ঠানিক আহ্বানের পরও বিএনপির নেতাকর্মীদের এই নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে ঢাকায় একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি রসিকতার সুরে জবাবে বলেন, হেফাজত মতিঝিলে অবস্থান নেয়ার পর বিএনপির লোকদের মধ্যে আনন্দের সীমা ছিল না। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছিল এবার কাজ হয়ে গেছে। হেফাজতে ইসলাম রাস্তায় বসে গেছে, সরকার এবার যাবে কোথায়! সরকারের পতন এবার অনিবার্য। বিএনপির নেতাকর্মীরা তখন মনের আনন্দে কাপড় ইস্ত্রি দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সফেদ জামা-কাপড় দরকার। ফুরফুরে পরিচ্ছন্ন ইস্ত্রি করা জামা-কাপড়ে ক্ষমতায় বসতে হবে। জামা-কাপড় ইস্ত্রি দেয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা। এজন্যই মূলত দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হেফাজত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর সময় পাননি ঢাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা। এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবার ছাড়া আর কেউ রাজনীতি করেন না। সবাই ক্ষমতায় যাওয়ার নেশায় ব্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন, হেফাজতে ইসলামের অবস্থানে পাশে দাঁড়ানো দরকার। এজন্যই তিনি পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই আহ্বানে দলের নেতাকর্মীরা খুব একটা সাড়া দিয়েছে বলে কারও চোখে ধরা পড়েনি। কোনো কারণে হেফাজতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে সঙ্কোচ থাকলে পাশে দাঁড়ানোর নানা কৌশল ছিল। সেই কৌশলও তারা নেয়নি। বিএনপির নেতাকর্মীরা হেফাজতের সঙ্গে একাত্ম না হয়েও ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে পারতেন। কিন্তু সেটাও তারা করেননি। বিএনপি অন্তত এই রাজনীতিটা করলে রাতের অন্ধকারে হেফাজতের অবস্থানে নির্বিচারে গুলি চালানোর সাহস পেত না সরকার। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় বিএনপির অবস্থান থাকলে সরকারকে অন্তত সেদিকেও নজর দিতে হতো। তখন একদিকে আক্রমণ চালালে আরেকদিকে অবস্থান থাকত। কেউ কেউ আবার বলছেন, বিএনপি সংঘাত এড়াতে চায়। আবার কেউ কেউ বলছেন হেফজাতের নিরীহ কর্মীদের পাশে না দাঁড়ানোর খেসারতও বিএনপিকে দিতে হবে ভবিষ্যত রাজনীতিতে। ভবিষ্যতে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির এই নিষ্ক্রিয়তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই আগাম মন্তব্য করছেন। তবে সেটা সময়ই বলে দেবে। এসবই হচ্ছে একেবারে সাধারণ বিশ্লেষকদের তাত্ক্ষণিক মন্তব্য।
বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। শাহবাগের অবস্থানের দিকে তাকালেই হয়। সেখানে সরকার সার্বিকভাবে তাদের পাশে ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক ভারতপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রথম দিন থেকেই প্রকাশ্যে শাহবাগে উপস্থিত ছিল। তারা শাহবাগের আন্দোলনের নামে যা ঘটছিল সেটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। এসব দেখেও কি বিএনপি শিক্ষা নিতে পারেনি! আন্দোলন কীভাবে ধরে রাখতে হয় আওয়ামী লীগ শাহবাগে দেখিয়ে দেয়ার পরও বিএনপি পারল না। বেগম খালেদা জিয়ার নামে আহ্বান জানানোর পরও সেই রাতে হেফাজতের পাশে রাজপথে দেখা গেল না বিএনপিকে।
কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আর আওয়ামী লীগ এই সুযোগ পেলে রোববার ঢাকাজুড়ে আগুন জ্বলত। তবে বিএনপি এরকম আগুন জ্বালানোর রাজনীতি করে না বলেই শান্ত ছিল। বিএনপি হচ্ছে শান্তিপ্রিয় মানুষের দল। এজন্যই হয়তো অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে নিজেদের উপস্থিতি রাজপথে দেখায়নি সেদিন। তারপরও হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে মানুষের আস্থা তার প্রতি আরও বেড়েছে। তার যে আন্তরিকতার কমতি ছিল না সেটা বুঝতে পারছে মানুষ। কিন্তু তার দলের সুবিধাবাদী নেতারা শুধু ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায়, এটাই হলো সমস্যা। আর এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয় বেগম জিয়ার পরিবারকে। দলের নেতাকর্মীদের কৃতকর্মের খেসারত দিতে হয় তার পরিবারের সদস্যদের।
হেফাজতে ইসলাম তো এমন কোনো দাবি দেয়নি যে বিএনপি একমত পোষণ করতে পারে না। হেফাজতের ১৩ দফার প্রথমটি হচ্ছে বিএনপির রাজনীতি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনা অনুযায়ী সংবিধানের মূলনীতিতে সব কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধানটি সংযোজন করেছিলেন। এটা বিএনপির রাজনীতিরই মূলনীতি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এসে এটা বাতিল করেছে। তার স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম বরং বিএনপির রাজনীতির মূলনীতিকে ১ নম্বর দাবি হিসেবে উত্থাপন করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেহায়াপনা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এখানেও কোনো মুসলমানের দ্বিমত থাকার কথা নয়। বেহায়াপনা, অবাধ মেলামেশা (যা শাহবাগে দেখা গেছে, রাতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে অবস্থান করেছে
বন্ধের দাবি জানিয়েছে। বরং হেফাজতে ইসলামের এই ১৩ দফাকে আওয়ামী প্রচারণার মাধ্যমে বলা হয়েছে মধ্যযুগে ফিরে যাওযার দাবি। বিএনপির একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা আওয়ামী প্রচারণায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তারা মনে করেছেন, এই দাবিগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করলে ভারত আর আমেরিকা যদি আবার অখুশি হয়! তাতে হয়তো ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের প্রয়োজন রয়েছে, জনগণের ভাষা বুঝতে হবে—সেটা যেন তারা ভুলে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বুঝলেও তার দলের সুবিধাবাদী নেতারা বুঝতে চাইছেন না। হেফাজতে ইসলামের যারা আন্দোলন করছেন তাদের সম্পর্ক হচ্ছে এদেশের নাড়ির সঙ্গে। একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে গণভোট হলে অবশ্যই সাধারণ মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়া যাবে।
সুতরাং সাধারণ মানুষকে ভয় না পেয়ে শুধু বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়া কতটুকু সম্ভব হবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর এটা মনে রাখতে হবে, হেফাজতে ইসলামের এই আন্দোলন আওয়ামী লীগ শক্তি দিয়ে দমন করতে পারলে বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না রাজপথে এরকম আন্দোলন গড়ে তোলা। আন্দোলন ছাড়া নির্দলীয় সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ কখনও মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ ও সরকারি জোটের বাম নেতাদের বক্তব্যের ভাষাগুলো বিশ্লেষণ করলে একেবারে পরিষ্কার, নির্দলীয় সরকারের দাবি তারা মেনে নেবে না। নির্দলীয় সরকার ছাড়া ভোট হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে কখনও সরানো যাবে না। দেশ কি তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে!
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত
nomanoliullah@yahoo.com
মতিঝিলের গণহত্যা ও ভবিষ্যত্ রাজনীতি
অ লি উ ল্লা হ নো মা ন
বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। রাষ্ট্রীয় টাকায় পোষা পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর
দিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করেছে সরকার। রাষ্ট্রীয় টাকায় লালিত এই বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের ওপর। তাদের সঙ্গে রয়েছে আওয়ামী অস্ত্রবাজ গুণ্ডারা। ইউ টিউবে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে একজন বলেছেন, রাতে মোবাইল দিয়ে ফটো তুলছিলেন এমন কয়েকজনকেও হত্যা করা হয়েছে। হেফজাতের অবস্থান কর্মসূচিতে দিনের ক্লান্তি নিয়ে অনেকেই রাজপথে ঘুমাচ্ছিলেন। এই ঘুমন্ত মানুষের ওপর চালানো হয়েছে ব্রাশফায়ার। যারা রাস্তায় অবস্থানের নিরাপত্তার জন্য সামনে ছিলেন, ব্রাশফায়ার করে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। সামনের সারির কেউ বেঁচে নেই।
গত রোববার হেফাজতে ইসলামের পূর্ব ঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে দিনের বেলায় পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং জনগণের টাকায় লালিত পুলিশ আর র্যাব। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ। এখানে হেফাজতের এক কর্মীকে আওয়ামী লীগ পিটিয়ে হত্যা করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া হেফাজত কর্মীর দেহে আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী লাঠি দিয়ে পেটানোর দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ছবি-ই কথা বলছে সেখানে কী ঘটেছিল। এখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
এই ঘটনায় উস্কানি দিয়েছে একশ্রেণীর আওয়ামী ইলেকট্রনিক মিডিয়া। রোববার দুপুরে বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান (বর্তমান সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা
সময় টেলিভিশনে সম্প্রচার দেখছিলাম। জাগো বিডি নামের একটি ওয়েবসাইটের কল্যাণে বাংলাদেশের সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় বসে দেখার সুযোগ রয়েছে। টেলিভিশনটির রিপোর্টার গুলিস্তানের এই ঘটনা বর্ণনা করার সময় বলছিলেন, হেফাজতের কর্মসূচি প্রতিহত করতে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাধারণ নাগরিকরাও। তখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল, পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অস্ত্রবাজ গুণ্ডা বাহিনীর হাতে লাঠি। এই মিডিয়াগুলোর চোখে আওয়ামী অস্ত্রবাজরা হলো সাধারণ নাগরিক! বাকি যারা রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ ছিলেন তারা সাধারণ নাগরিক নন! এসব দলবাজ মিডিয়ার চোখে হেফজাতের কর্মীরা যেন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী! আর অস্ত্রবাজ আওয়ামীরাই হলো সাধারণ নাগরিক!
গুলিস্তানে আওয়ামী গুণ্ডাদের (সময় টেলিভিশনের চোখে সাধারণ নাগরিক
আক্রমণ দিয়ে তাণ্ডবের শুরু। সময় টেলিভিশনের মতো একই সুরে ৭১ টিভি চ্যানেল, চ্যানেল ২৪ একই বর্ণনা দিচ্ছিল। অর্থাত্ হেফাজত কর্মীদের ওপর সব দোষ চাপানোর জন্য মরিয়া ছিল এই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো। তাতে তারা পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের কিছু দৃশ্য তখন দেখাচ্ছিল। এটা হচ্ছে বাংলাদেশ সময় বেলা ২টার ঘটনা।
আওয়ামী গুণ্ডাদের আক্রমণের মুখে হেফাজত কর্মীরাও তখন নিজেদের রক্ষার চেষ্টায় মরিয়া। পুলিশ ও র্যাব আওয়ামী গুণ্ডাদের রক্ষার জন্য হেফাজতের মিছিলে গুলি চালায়। তাতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকাজুড়ে। এই এলাকায় আওয়ামী গুণ্ডা ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ১৬ জন শাহাদাতবরণ করেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকিদের লাশ পাওয়া যায়নি। এই এলাকাটুকু ছাড়া হেফাজতের বাকি সারা দেশের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। এই হত্যকাণ্ডের ঘটনায় মতিঝিলে হেফাজতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যখন লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় তখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের লাশ দেখার পরও পাল্টা আক্রমণের জন্য মতিঝিল থেকে কেউ পল্টন, গুলিস্তান বা বায়তুল মোকাররমের দিকে রওনা দেয়নি। সমাবেশের মঞ্চ থেকে নেতারা ঘোষণা করছিলেন শান্ত থাকার জন্য। নেতাদের ঘোষণায় উপস্থিত সবাই ধৈর্যের পরিচয় দেন। সেদিন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই হেফাজতে ইসলামকে রাজপথে অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। হেফজাতে ইসলাম শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মতিঝিলে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য। যদিও শাহবাগে অবস্থান নেয়া নাস্তিকদের জনগণের টাকায় লালিত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্তরে-স্তরে নিরাপত্তা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। একটানা তিন মাস শাহবাগে অবস্থান করেছে নাস্তিকরা। নিরাপত্তা দিয়েছে সরকার। ইসলামবিদ্বেষী এই নাস্তিকদের দ্বারা আল্লাহ ও রাসুলকে (সা.) নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদেই হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন। নাস্তিকদের দিনের পর দিন নিরাপত্তা দিয়ে, খাবার সরবরাহ করে, টাকা বিলিয়ে অবস্থানে উত্সাহিত করেছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। উস্কানি দিয়েছে আওয়ামী ও বামপন্থী মিডিয়াগুলো। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোর প্রচারণা দেখলে তখন মনে হতো, বাংলাদেশে আর কোনো মানুষ ঘরে বসে নেই। সবাই শাহবাগে চলে এসেছে।
অপরদিকে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানকে সরকার একদিনও সহ্য করেনি। বেসরকারি টেলিভিশনওয়ালারা শাহবাগের সিকিভাগও প্রচার করেনি হেফাজতের সমাবেশ। বরং সমাবেশ ও অবরোধের কারণে মানুষের যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছিল সেই বিষয় ফলাও করে প্রচার চালানোর চেষ্টা করেছে। আগুন কে বা কারা দিয়েছে সেটা অনুসন্ধানের আগেই হেফাজতের কর্মীদের দায়ী করে রাস্তা থেকে ধারাভাষ্য দেন রিপোর্টাররা।
রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে ১০ হাজারের বেশি বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী গুলি চালায় মতিঝিলে। সেখান থেকে আগেই সরিয়ে দেয়া হয় মিডিয়া কর্মীদের। রাতে বন্ধ করে দেয়া হয় দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি চ্যানেল। এই অভিযানে মতিঝিলে কত লোক হতাহত হয়েছে কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। হতাহতের শিকার লাশগুলোরই বা কী হয়েছে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। লাশ নিয়ে নানা গুজব রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে ঢাকায় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতে মতিঝিলে যৌথ বাহিনীর গুলিতে কয়েকশ লোক শাহাদাত বরণ করেছেন। রাত সাড়ে ৩টায় যখন অপারেশন চলছিল তখন একজন ফটো সাংবাদিকের সঙ্গে আমার মোবাইলে কথা হয়। তার কাছে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাওয়া মাত্র বলেনগুলির আওয়াজে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, আপনি গুলির শব্দ শোনেন। তখন মোবাইলে অপর প্রান্ত থেকে ঝড়ের মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ওই ফটো সাংবাদিক তখন মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের এক দেয়ালের পাশে শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন। সকালে ইমেইলে রাজপথে পড়ে থাকা কিছু লাশের ছবি পাটিয়েছেন তিনি। রাজপথে সেদিন গণহত্যা চালিয়ে কত লোকের প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে সেটার হিসাব পেতে হয়তোবা কিছুটা সময় লাগবে। তবে একদিন এর সঠিক হিসাব বের হয়ে আসবে। এরই মধ্যে হংকং ভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইট্্স কমিশনের তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়াই হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শত শত লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে জনগণের টাকায় কেনা বুলেট।
৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শেষে রাতে যারা মতিঝিলে অবস্থান করছিলেন তারা সবাই ছিলেন নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষ। তারা কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন না বা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিও তারা কোনো দিন করেন না। এই নিরীহ মানুষগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ইজ্জত রক্ষার দাবিতে এখানে সমবেত হয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে জালিমদের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের লাশ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটাও পরিবার জানতে পারবে না।
আল্লামা আহমদ শফীর আহ্বানে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে প্রতিটি পয়েন্টে ছিল লাখো জনতা। তবে রাজপথে অনুপস্থিত ছিল আগামীতে সরকারে যেতে মরিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি
। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে বিকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন মূখপাত্র শামসুজ্জামান দুদু। সংবাদ সম্মেলনে তিনি দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন হেফাজত কর্মীদের পাশে থাকার জন্য। ঢাকায় অবস্থান নেয়া হেফাজত কর্মীদের মুসাফির হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপির মুখপাত্র শামসুজ্জামান দুদু সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বান পৌঁছে দেন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে। তারপরও ঢাকা মহানগর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতের অবস্থানের সঙ্গে ছিল বলে দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়েনি। আনুষ্ঠানিক আহ্বানের পরও বিএনপির নেতাকর্মীদের এই নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে ঢাকায় একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি রসিকতার সুরে জবাবে বলেন, হেফাজত মতিঝিলে অবস্থান নেয়ার পর বিএনপির লোকদের মধ্যে আনন্দের সীমা ছিল না। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছিল এবার কাজ হয়ে গেছে। হেফাজতে ইসলাম রাস্তায় বসে গেছে, সরকার এবার যাবে কোথায়! সরকারের পতন এবার অনিবার্য। বিএনপির নেতাকর্মীরা তখন মনের আনন্দে কাপড় ইস্ত্রি দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সফেদ জামা-কাপড় দরকার। ফুরফুরে পরিচ্ছন্ন ইস্ত্রি করা জামা-কাপড়ে ক্ষমতায় বসতে হবে। জামা-কাপড় ইস্ত্রি দেয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা। এজন্যই মূলত দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হেফাজত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর সময় পাননি ঢাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা। এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবার ছাড়া আর কেউ রাজনীতি করেন না। সবাই ক্ষমতায় যাওয়ার নেশায় ব্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন, হেফাজতে ইসলামের অবস্থানে পাশে দাঁড়ানো দরকার। এজন্যই তিনি পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই আহ্বানে দলের নেতাকর্মীরা খুব একটা সাড়া দিয়েছে বলে কারও চোখে ধরা পড়েনি। কোনো কারণে হেফাজতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে সঙ্কোচ থাকলে পাশে দাঁড়ানোর নানা কৌশল ছিল। সেই কৌশলও তারা নেয়নি। বিএনপির নেতাকর্মীরা হেফাজতের সঙ্গে একাত্ম না হয়েও ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে পারতেন। কিন্তু সেটাও তারা করেননি। বিএনপি অন্তত এই রাজনীতিটা করলে রাতের অন্ধকারে হেফাজতের অবস্থানে নির্বিচারে গুলি চালানোর সাহস পেত না সরকার। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় বিএনপির অবস্থান থাকলে সরকারকে অন্তত সেদিকেও নজর দিতে হতো। তখন একদিকে আক্রমণ চালালে আরেকদিকে অবস্থান থাকত। কেউ কেউ আবার বলছেন, বিএনপি সংঘাত এড়াতে চায়। আবার কেউ কেউ বলছেন হেফজাতের নিরীহ কর্মীদের পাশে না দাঁড়ানোর খেসারতও বিএনপিকে দিতে হবে ভবিষ্যত রাজনীতিতে। ভবিষ্যতে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির এই নিষ্ক্রিয়তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই আগাম মন্তব্য করছেন। তবে সেটা সময়ই বলে দেবে। এসবই হচ্ছে একেবারে সাধারণ বিশ্লেষকদের তাত্ক্ষণিক মন্তব্য।
বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। শাহবাগের অবস্থানের দিকে তাকালেই হয়। সেখানে সরকার সার্বিকভাবে তাদের পাশে ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক ভারতপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রথম দিন থেকেই প্রকাশ্যে শাহবাগে উপস্থিত ছিল। তারা শাহবাগের আন্দোলনের নামে যা ঘটছিল সেটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। এসব দেখেও কি বিএনপি শিক্ষা নিতে পারেনি! আন্দোলন কীভাবে ধরে রাখতে হয় আওয়ামী লীগ শাহবাগে দেখিয়ে দেয়ার পরও বিএনপি পারল না। বেগম খালেদা জিয়ার নামে আহ্বান জানানোর পরও সেই রাতে হেফাজতের পাশে রাজপথে দেখা গেল না বিএনপিকে।
কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আর আওয়ামী লীগ এই সুযোগ পেলে রোববার ঢাকাজুড়ে আগুন জ্বলত। তবে বিএনপি এরকম আগুন জ্বালানোর রাজনীতি করে না বলেই শান্ত ছিল। বিএনপি হচ্ছে শান্তিপ্রিয় মানুষের দল। এজন্যই হয়তো অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে নিজেদের উপস্থিতি রাজপথে দেখায়নি সেদিন। তারপরও হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে মানুষের আস্থা তার প্রতি আরও বেড়েছে। তার যে আন্তরিকতার কমতি ছিল না সেটা বুঝতে পারছে মানুষ। কিন্তু তার দলের সুবিধাবাদী নেতারা শুধু ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায়, এটাই হলো সমস্যা। আর এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয় বেগম জিয়ার পরিবারকে। দলের নেতাকর্মীদের কৃতকর্মের খেসারত দিতে হয় তার পরিবারের সদস্যদের।
হেফাজতে ইসলাম তো এমন কোনো দাবি দেয়নি যে বিএনপি একমত পোষণ করতে পারে না। হেফাজতের ১৩ দফার প্রথমটি হচ্ছে বিএনপির রাজনীতি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনা অনুযায়ী সংবিধানের মূলনীতিতে সব কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধানটি সংযোজন করেছিলেন। এটা বিএনপির রাজনীতিরই মূলনীতি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এসে এটা বাতিল করেছে। তার স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম বরং বিএনপির রাজনীতির মূলনীতিকে ১ নম্বর দাবি হিসেবে উত্থাপন করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেহায়াপনা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এখানেও কোনো মুসলমানের দ্বিমত থাকার কথা নয়। বেহায়াপনা, অবাধ মেলামেশা (যা শাহবাগে দেখা গেছে, রাতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে অবস্থান করেছে
বন্ধের দাবি জানিয়েছে। বরং হেফাজতে ইসলামের এই ১৩ দফাকে আওয়ামী প্রচারণার মাধ্যমে বলা হয়েছে মধ্যযুগে ফিরে যাওযার দাবি। বিএনপির একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা আওয়ামী প্রচারণায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তারা মনে করেছেন, এই দাবিগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করলে ভারত আর আমেরিকা যদি আবার অখুশি হয়! তাতে হয়তো ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের প্রয়োজন রয়েছে, জনগণের ভাষা বুঝতে হবেসেটা যেন তারা ভুলে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বুঝলেও তার দলের সুবিধাবাদী নেতারা বুঝতে চাইছেন না। হেফাজতে ইসলামের যারা আন্দোলন করছেন তাদের সম্পর্ক হচ্ছে এদেশের নাড়ির সঙ্গে। একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে গণভোট হলে অবশ্যই সাধারণ মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়া যাবে।
সুতরাং সাধারণ মানুষকে ভয় না পেয়ে শুধু বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়া কতটুকু সম্ভব হবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর এটা মনে রাখতে হবে, হেফাজতে ইসলামের এই আন্দোলন আওয়ামী লীগ শক্তি দিয়ে দমন করতে পারলে বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না রাজপথে এরকম আন্দোলন গড়ে তোলা। আন্দোলন ছাড়া নির্দলীয় সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ কখনও মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ ও সরকারি জোটের বাম নেতাদের বক্তব্যের ভাষাগুলো বিশ্লেষণ করলে একেবারে পরিষ্কার, নির্দলীয় সরকারের দাবি তারা মেনে নেবে না। নির্দলীয় সরকার ছাড়া ভোট হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে কখনও সরানো যাবে না। দেশ কি তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে!
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত
nomanoliullah@yahoo.com