আড়িয়ল বিলে আগুন
আতাউস সামাদ 
শেখ হাসিনা আড়িয়ল বিল থেকে তার বিমানবন্দর প্রকল্প নিয়ে সরে এলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন। তাকে অন্তত একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে অনুরোধ করব যে, এই বিমানবন্দর প্রকল্পটি কার কার জন্য সরকারি অর্থ, তার মানে জনগণের টাকা, দেদার লুট করার সুযোগ করে দিচ্ছে।
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন, 'আমাদের আছেন এক অশান্তি বেগম।' যতদূর মনে পড়ে, হয় আওয়ামী লীগের, না হয় জাতীয় পার্টির কোনো এক নেতা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কটাক্ষ করে ওই মন্তব্য করেছিলেন। তখন বোধহয় দেশে রাজনৈতিক 37;চলাবস্থা চলছিল আর বিএনপি ও বেগম জিয়া তাদের দাবিতে অনড় ছিলেন। অবস্থাবিশেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও একই রকম আচরণ করেছেন। ঠাট্টা-মশকরাটা বেগম জিয়াকে নিয়েই বেশি হয়েছিল। তবে আজ যে ওসব কথা মনে পড়ছে তা 'অশান্তি' শব্দটার দরুন। এটা সবাই উপলব্ধি করছেন, বাংলাদেশে আমরা এখন অশান্তিতে ভরা এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত খুবই সামান্য সময়ের খোঁজ পাওয়া যাবে, যখন দেশের মানুষ শান্তিতে থেকেছে; বরং দেশের ও সরকারের সময় পার হচ্ছে একটার পর একটা সংকটের মধ্য দিয়ে। প্রথমেই তো হলো বিডিআর বিদ্রোহ ও ঢাকার পিলখানায় বিদ্রোহীদের হাতে সেনা কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞ। সাবেক বিডিআর সৈন্যদের মধ্যে যে ক্ষোভ ধূমায়মান ছিল, তা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নজরে এসেছিল ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ও পরে। যদিও তা যে ২০০৯-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত নৃশংসতায় রূপ নেবে, তা বোঝা যায়নি। কিন্তু যেটুকু সমস্যা জানা গিয়েছিল তা-ও সমাধান করার উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়নি। ওই বিদ্রোহের দিন সরকার বেশ জটিল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল; কিন্তু জনগণ সেদিন দল-মত নির্বিশেষে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকায় তারা ব্যর্থ হয় ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এরপর এসেছে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের পাহাড়সম মূল্যস্ফীতি। বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিককালে দ্বিতীয় দফায় গম, আটা, চিনি, চাল ও ডালের মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয় ২০০৭ সালেই। তবু ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে, মোটা চাল ১০ টাকা কেজি দরে দেবে। সেই কথা আকাশ কুসুম কল্পনায় পর্যবসিত হয়েছে। দেশের মানুষ দেখেছে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে মুনাফাখোরির অতি জঘন্য খেলা। সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি অস্থির করে তোলা বাজারের ওপর। অথচ প্রথমত কেউ আওয়ামী লীগকে মাথার দিব্যি দেয়নি ভোটের সময় অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিতে। তারপরও অবস্থা যখন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনও আন্তর্জাতিক মূল্য পরিস্থিতি ও তার সঙ্গে বাংলাদেশে জি472;িসের দরদাম কতখানি সাযুজ্যপূর্ণ, তা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা হয়নি। তা যে হয়নি তার একটা কারণ বোধহয় এই যে, আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য যতখানি মূল্যস্ফীতি হতে পারে, বাংলাদেশে আসলে হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে, আওয়ামী লীগ ঘরানার মহাপ্রতিভাধর ও দারুণ ক্ষমতাশালী যে কয়েকজন অর্থনীতিবিদ চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হওয়ার ভাব নিয়ে আঙুলের দাগে অঙ্ক কষে বলে দিতেন, জোট সরকারের আমলে তাদেরই সিন্ডিকেট মূল্যস্ফীতি তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে, তারাও এখন আর কোনো আওয়াজ করেন না। মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বা এমন দুরবস্থা তৈরির বাজিকরদের 'আপনা আদমি' হিসেবে চিনতে পেরে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন।
পাশাপাশি ঘটেছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হওয়া। সরকার কোথায় পুলিশ, র্যাব ও আনসারদের কার্যকর ও যোগ্যতর করে তুলবে_ তা না, তার জায়গায় এই বাহিনীগুলোর দুর্বলতা আর ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যস্ত। বিচার বিভাগেও চলেছে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সরকারের আইন অফিসারদের মধ্যে দেখা গেছে মিথ্যা ও অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা। বিচারপতিদের কোনো কোনো রায় ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুক্তভোগী ও জনগণের মধ্যে জেগেছে প্রশ্ন। এখন তো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আন্দোলনে আছে। এসব নিয়ে যখন হতাশা বাড়ছে, ঠিক তখনই হলো শেয়ারবাজারে ধস, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দরপতন। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এতে বিন্দুমাত্র দুঃখ বা লজ্জিত না হয়ে উল্টো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যাচ্ছেতাই ভাষায় গালি দিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান তো তাদের দেশের শত্রু পর্যন্ত বলে ফেললেন। পরে কী মনে করে তারা কিছুটা সুর পাল্টালেন এবং অর্থমন্ত্রী খানিক ত্রুটি স্বীকারও করলেন, তা আমার জানা নেই। হবে হয়তো প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখেছেন কিছু একটা করা দরকার। আবার এও হতে পারে যে, কাউকে বাঁচিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কোনটা আসল আর কোনটা নাটক, তা 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' ধরনের নাগরিকদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। ওসব বিষয় হলো রাজন্য আর তাদের বাজিকরদের বোঝার জন্য।
এতসব সংকটের বোঝা কমতে না কমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন যে একটা খাদ্যভাণ্ডারে বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করতে কোমর বে33;ধে নামলেন, তা কল্পনাও করতে পারছি না আমরা। আমাদের তো মনে হচ্ছে, প্রকৃতির লীলাভূমি যে বিশাল জলাভূমি পদ্মার বন্যার প্রকোপ কমানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে আসছে, সেটিকে আংশিক হলেও ভরাট করে বিমানবন্দর বানাতেই হবে_ তিনি এমন গোঁ ধরেছেন কেন? এ তো সুস্থ চিন্তার লক্ষণ নয়! আমরা খোলা চোখেই দেখতে পাচ্ছি, বর্ষায় পদ্মার অনেকখানি পানি নিজ বুকে ধরে রেখে সুপ্রাচীন আড়িয়ল বিল বন্যা না হতে বা কমাতে সাহায্য তো করেই, তার ওপর এই বিলে একরে ১০০ মণ হারে ২০ হাজার একরে প্রায় ২০ লাখ মণ ধান হয়। প্রায় দুই লাখ জেলে এই বিলে মাছ ধরে, আরও এক লাখ লোক রবিশস্য চাষ ও গবাদিপশু পালন করে। ধান বোনা ও কাটার কাজ করে চার লাখ লোক। এই বিলের ধান, মাছ ও সবজি সারাদেশে যায়। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলে আসছেন, দেশের প্রতি ইঞ্চি খালি জায়গায় খাদ্য উৎপাদন করতে হবে, সেখানে আড়িয়ল বিলের মতো খাদ্যভাণ্ডারের একটা অংশ হলেও ভরাট করে দেশের বিশাল ক্ষতি করার মতো কাজ তার সরকার করতে যাচ্ছে? এ কেমন কথা! কিন্তু সরকার ভুল করলেও ওই ভুলের জন্য যাদের পেটে লাথি পড়েছে এবং যারা আশ্রয়হীন হতে যাচ্ছে, তারা ভুল করেনি। আড়িয়ল বিল যাতে ভরাট না করা হয়, সে জন্য তারা প্রথমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছে। এমন ধরনের আরও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ায় তারা লাঠিসোটা হাতে সড়ক অবরোধ করতে নেমেছে। পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। দুঃখজনকভাবে একজন আহত পুলিশ কর্মকর্তা মারা গেছেন। কিন্তু তার শোধ নিতে গিয়ে প্রায় চবি্বশ হাজার অজ্ঞাতপরিচয় লোককে চারটি মামলার আসামি করা হয়েছে। কয়েকটি গ্রামের সব পুরুষ লোক পালিয়ে গেছেন। বাড়িতে যে নারীরা রয়েছেন, তাদের অনেকেই পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সাংবাদিকরাও নিগৃহীত হয়েছেন। পুলিশের মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন। এই জুলুমবাজি কি বঙ্গবল্পুব্দর খ্যাতি বাড়াবে?
এদিকে আড়িয়ল বিল নিয়ে গত সোমবার যেসব সংঘর্ষ হয়েছে তার জন্য এক আওয়ামী লীগ নেতা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার সহকর্মীদের উস্কানিদাতা হিসেবে প্রধান আসামি করে মামলা করেছেন এবং বিজ্ঞ বিচারকের নির্দেশে পুলিশ সেই মামলা নিয়েছে। বেগম জিয়া তাতে ঘাবড়াননি। তিনি আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনার বিরোধিতা করায় অবিচল আছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতারাসহ অনেকেই মনে করছেন, বেগম জিয়া ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা যাতে এ মামলা-হামলায় বিরক্ত হয়ে জাতীয় সংসদ বর্জন করেন, সে জন্যই শেখ হাসিনার সরকার তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করিয়েছে। হয়রানি করা ছাড়া আর ঠিক কোন উদ্দেশ্যে সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দলকে এভাবে নিপীড়ন ও উত্ত্যক্ত করছে, তা আমরা সঠিকভাবে না বলতে পারলেও এটুকু বলতে পারি, এই তামাশা করে বর্তমান সরকার দেশে গণতন্ত্রচর্চা করা বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করায় কোনো সহায়তা করছে না, বরং ঠিক উল্টোটাই করছে। তবে আমরা আশা করব, এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না। আমরা চাই বিএনপি এসব উস্কানি উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে যাক এবং সেখানে জনগণের কথা বলবে। পৌরসভা নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে জনগণ বিএনপিকে পরিষ্কার সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপিকে এখন সব ফোরামে জনগণের জন্য কথা বলতে হবে। আন্দোলন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অনুরোধ করব, তিনি যেন চাটুকার উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও বিশেষ করে আমলাদের সম্পর্কে অতি সজাগ থাকেন। তারা যেভাবে প্রয়োজনীয় প্রাক-অনুমোদন, পরিবেশ ও ভূ-প্রাকৃতিক নিরীক্ষা, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির জরিপ, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য এলাকাটির উপযোগিতা এবং পরিকল্পনা ছাড়া আড়িয়ল বিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বানানোর মচ্ছবে নেমেছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য নির্ঘাত একটি সাতিশয় কঠিন দুর্নীতির মামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। শেখ হাসিনা আড়িয়ল বিল থেকে তার বিমানবন্দর প্রকল্প নিয়ে সরে এলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন। তাকে অন্তত একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে অনুরোধ করব, এই বিমানবন্দর প্রকল্পটি কার কার জন্য সরকারি অর্থ, তার মানে জনগণের টাকা, দেদার লুট করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমাদের এও সন্দেহ হয় যে, পুরো প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হচ্ছে একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক জলাধার ও খাদ্যভাণ্ডারকে ভূমিদস্যুদের লুটপাটের স্বর্গরাজ্য করে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কেন ঢুকবেন আর বঙ্গবন্ধুর নামই বা কেন ব্যবহার হবে? আমরা চাই, বাংলাদেশ ভালো থাকুক এবং সুস্থ সমাজের জন্য থাকুক। গত মঙ্গলবার রাতে এ প্রকল্প নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অধিকর্তার সাক্ষাৎকার দেখলাম সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তার কথা শুনে মনে হয়েছে, আমাদের খোয়াবে বিরিয়ানি ভক্ষণ করানোর চেষ্টা চলছে। সাধু, সাবধান।
আতাউস সামাদ :সাংবাদিক