আমি আল বদর বলছি - অধ্যায় এক
Written by কে এম আমিনুল হক Friday, 15 August 2008 00:00
একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর। কিশোরগঞ্জে মুক্তিবাহিনী ও হিন্দুস্তানী সেনার সম্মিলিত আক্রমণের মুখে প্রচণ্ড প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজাকার, আলবদর, মুজাহিদ ও পুলিশের মৃত্যুকামী সদস্যরা। ১৬ ডিসেম্বরে হিন্দুস্তানের হাতে পাকিস্তানী বাহিনী অস্ত্র সমর্পনের পর যে বিজয় সূচিত হয়েছে, কিশোরগঞ্জের প্রতিরোধ যেন তার কলঙ্কের তিলক। অসংখ্য শেল প্রতিনিয়ত এসে পড়ছে শহরের বিভিন্ন অবস্থানে। দালানগুলোর ইট খসে খসে পড়ছে। হতাহতের খবরও আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। গুলী, অজস্র গুলী, বৃষ্টির মত গুলী, তবু কারো দুঃসাহসে চিড় ধরেছে বলে মনে হয় না। প্রতিরোধের প্রচণ্ড নেশায় উন্মত্ত সকলে। কিশোরগঞ্জের এই প্রতিরোধকে বিশাল সমুদ্রের ছোট একটি ঢেউ অথবা বুদ বুদ কোনটি বলব সেটা আমার জানা নেই। ঝঞ্ঝা অথবা ঝড়ো হাওয়ার উন্মত্ততা শেষ হয়েছে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পরেই, অর্থাৎ আগের দিন। কিন্তু কিশোরগঞ্জের ঝড় তখনও। তখনও প্রচণ্ড লড়াই। আমি জানি এর শেষ কোথায়। রসদের পরিমাণও আমার জানা। সরবরাহের সম্ভাবনা আর কোন দিনই আমাদের সামনে আসবে না। আমার জানবাজ সহকর্মীদের সামনে পশ্চাৎ অপসারণ অথবা আত্মসমর্পণের কথা বলবার দুঃসাহস আমার নেই। ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা। এতগুলো জীবনের ঝুঁকি! অন্তহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে আমার আপোষহীন সিপাহীরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। আমি উল্কার মত ছুটে বেড়াচ্ছি এক বাংকার থেকে আর এক বাংকারে, এক ট্রেঞ্চ থেকে আর এক ট্রেঞ্চে, এক অবস্থান থেকে আর এক অবস্থানে। সবার একই ভাষা, সেই ১৪শ বছর আগের কারবালার ভাষা, যে ভাষায় হযরত হোসেন (রাঃ
প্রতি তাঁর সহগামীরা আনুগত্য ব্যক্ত করেছিলেন। উৎকণ্ঠা কারো নেই। সবার চোখে আর চাওনিতে অব্যাহত লড়াইয়ের দৃপ্ত শপথ ঠিকরে বেরুচ্ছে। আমার মন থেকে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ধীরে ধীরে অপসারিত হচ্ছে। আমার সহকর্মীদের মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করার ইচ্ছার মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। ১৪শ বছর পর কারবালার নুতন দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য আমার মনকে আমি তৈরি করে ফেলেছি।
বেলা গড়িয়ে এলো। সূর্যটা অস্তাচলে। গোধূলির রঙ আমি দেখছি। এ রঙে পৃথিবী এমন করে কোনদিন দেখেছি বলে মনে হয় না। আকাশটা লালে লাল। সূর্যটার বুক বিদীর্ণ হয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আহত সূর্যের গোঙ্গানি যেন রণাঙ্গনে বিমূর্ত। মনে হয় রক্তাক্ত পথ দিয়েই সূর্যোদয় ঘটে। রক্ত-পিছল পথ দিয়ে সূর্যটা অস্তাচলে ঢলে পড়ে। দুনিয়ার মানচিত্রে পাকিস্তানের অভূদ্যয়, কত অজস্র জীবনের বিনিময়ে। কত খুন আর আগুনের পথ অতিক্রম করে মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২শ বছরের গোলামীর জিঞ্জির ছিঁড়েছে। মানচিত্রের একটা দিক থেকে পাকিস্তানের চিহ্ন মুছে ফেলতে তেমনি রক্ত ঝরবে এটাই স্বাভাবিক।
মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসল। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই। আমার মন-মানসিকতা আবার যেন শানিত হয়ে উঠল। না, কোন শক্তির কাছে নয় আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করাই আমাদের মঙ্গল। পানি নিয়ে ওযু করতে বসলাম। অন্তহীন ভাবনা। এ জাতির অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে আমার দুচোখ ফেটে পানি গড়িয়ে এলো। অশ্রু আর ওযুর পানিতে একাকার হয়ে গেল আমার মুখমণ্ডল। আল্লাহ দরবারে হাত তুললাম, ইয়া আল্লাহ্, ইয়া মাবুদ, ইয়া যাজা ও সাজার মালিক, সমস্ত জাতিকে কতিপয় উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক অন্ধ করে রেখেছে। আমার এ বেগুনাহ কাওমকে রাজনীতিকদের গুনাগারীর সাজা দিও না। তোমার ঐশী আযাব থেকে এদের আশ্রয় দাও।
প্রাণ ভরে নামাজ পড়লাম। তখন প্রত্যেকটি নামাজই মনে হত আমার জন্য শেষ নামাজ। মাগরিবের নামাজের বেশ কিছুক্ষণ পর নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় মওলানা আতাহার আলী সাহেবের টেলিফোন পেলাম। তিনি তার আল জামেয়াতুল এমদাদিয়া থেকে আমাকে তলব করেছেন। আমি মোটেও বিলম্ব না করে তার কাছে ছুটে গেলাম। পৌঁছে দেখলাম মহকুমা অফিসার জনাব আবদুর রহিম, মহকুমা পুলিশ অফিসার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বসে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের মহকুমা সেক্রেটারী অধ্যাপক জিয়াউদ্দিনকে দেখেই আমি ভয়ঙ্কর মানসিক বিপর্যয় অনুভব করলাম। মওলানা আতাহার আলী সাহেব এই অঞ্চলের আধ্যাত্মিক নেতা, তিনি আমাদের অনেকের আপোষহীন প্রেরণার উৎস। তাঁর শত শত অনুগামী এই প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয় অংশীদার। যাই হোক, আমি সালাম দিয়ে তার কোন নির্দেশ, বক্তব্য অথবা পরামর্শের প্রত্যাশা করছিলাম। আমার যেন মনে হচ্ছিল, তিনি কোন এক আপোষ ফর্মূলায় উপস্থিত হয়েছেন। আমি দৃষ্টি অবনত করে বসে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। মাথা উঁচু করে মাঝে মাঝে দেখছিলাম, মওলানা অপলকে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। তাঁর অশ্রুসজল সকরুণ চাওনি আমাকে বিব্রত করছিল ভয়ঙ্করভাবে। নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, আমিন, কুদরতের ফায়সালা আমাদের সপক্ষে নেই। ৫৪ হাজার বর্গমাইলের পাঁচ-দশ বর্গমাইল প্রতিরোধের প্রাচীর দিয়ে বিভ্রান্তির জোয়ার আটকাতে পারবে না। আওয়ামী লীগ নেতারা আত্ম-সমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, আমি মনে করি রক্তক্ষরণের চাইতে অস্ত্রসংবরণই উত্তম। হক-বাতিলের ফায়সালা আগামী দিনগুলোর জন্য রেখে দাও। তাঁর এই বক্তব্যে অনেক বেদনা, অনেক অন্তর্জ্বালা আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম। মওলানা আতাহার আলী সাহেবের নির্দেশকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস আমার নেই। কেননা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তিনি আমাকে ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন। তার সহযোগিতায় এবং সৎ পরামর্শে সমস্ত অন্যায় অপকর্মের ভাগাড়গুলোকে আমি নির্মূল করতে পেরেছি। আমার এও বিশ্বাস ছিল যে তিনি কোন অন্যায় অযৌক্তিক পরামর্শ দিতে পারেন না। এ ছাড়াও আমাদের এই বয়সটা আবেগ দ্বারা তাড়িত, আর তিনি এর বাইরে থেকে পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে দেখছেন। আমি তার নির্দেশ মেনে নিলাম সহজভাবে। আমি মোটেও দেরী না করে মওলানা আতাহার আলী সাহেবকে তাঁর নির্দেশ পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম। দেখলাম অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন প্রচণ্ড আক্রোশে আমার দিকে চেয়ে আছে। ফিরে এলাম আমার ডেরায়।
স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন অবস্থান থেকে সমস্ত গ্রুপের কমান্ডারকে ডেকে পাঠালাম। পরামর্শে বসলাম। অনেকেই শেষ অবধি যুদ্ধ চালিযে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করল। কিন্তু এর শেষ কোথায়? আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, রক্তাক্ত পরিণতি ছাড়া এর আশাব্যঞ্জক কোন দিকই অবশিষ্ট নেই। আরও বললাম, মওলানা আতাহার আলী সাহেব যুদ্ধ-বিরতির সপক্ষে সুপারিশ করাতে তাঁর অনুসারী মুজাহিদরা রণেভঙ্গ দিবে। এছাড়াও গুলীর মওজুদ নিঃশেষের পথে। এ নিয়ে হয়তো বা কয়েক ঘন্টা অথবা কয়েকদিন লড়তে সক্ষম হব। কিন্তু তারপর? তারপরও যদি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে কোন বাহিনীর এগিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকতো, তাহলে যে কোন ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত মনে করতাম। বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, সময় ও সুযোগমত যে যখন পারে আমার জানবাজ যোদ্ধারা রণাঙ্গন পরিত্যাগ করবে। আমাদের একটা সুবিধা ছিল যা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ছিল না। তা হল, গণ-আবরণে গা ঢাকা দেওয়ার সুবিধা। যেহেতু আমাদের ভাষা, বর্ণ, পোশাক-আশাক এবং চলাফেরার ব্যাপারে প্রতিপক্ষদের সাথে কোন ব্যবধানই ছিল না। সবাই মোটামুটি যুদ্ধকে এড়িয়ে নিজ নিজ দায়িত্বে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া সত্ত্বেও রাত ১০টা নাগাদ মওলানা আবদুর জব্বার সাহেবের ছেলে ইমদাদুল হক এবং শহীদুল্লাহ আমাকে না জানিয়ে মুজাহিদ, রাজাকার, আলবদর ও শহরের অতি উৎসাহী মানুষদের নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সপক্ষে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের করে। দেখলাম, ইসলামের সৈনিকদের আত্মোৎসর্গ করার উদ্দীপনা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমার সহকর্মী অসংখ্য তরুণ-প্রাণের করুণ পরিণতির কথা ভেবে আমার বুক চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল। ক্রমশ আমরা অসহায়ত্বের দোর গোড়ায় এগিয়ে চললাম। আমাদের দুর্জয় বন্দুকের নল ধীরে ধীরে বোবা হয়ে গেল। ১৮ তারিখ সকালে ইমদাদুল হক এবং শহীদুল্লাহকে মুক্তিফৌজরা নির্মমভাবে হত্যা করল। অন্যদিকে রাত্রেই আর এক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম, রাজাকার প্রধান মওলানা মহিউদ্দিন আযমী সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর সহানুভূতি পাওয়ার প্রত্যাশায় এক অতি উৎসাহী ভূমিকা নিলেন।
আল জামেয়াতুল এমদাদিয়া থেকে মাইক নিয়ে মওলানা আযমী সর্বত্র ঘোষণা দিলেন যে, আগামী কাল মুক্তিফৌজ অমুক অমুক সড়ক দিয়ে প্রবেশ করবে। আমাদের ভাইয়েরা তাদের প্রবেশ পথে কোন বাধার সৃষ্টি না করে অভিনন্দন জানাবে। এবং শহীদি মসজিদের সম্মুখভাগে আমাদের বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করবে। চুক্তিমত কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। এমন কি কোন প্রতিশোধ নেয়া হবে না। মওলানা আযমীর এই ঘোষণাও ছিল আমার নির্দেশের বাইরে। মওলানা আযমী হয়তো পরিস্থিতির চাপে বিদিশা হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রতিশ্রুতিকে রাসূলুল্লাহর (সাঃ
মক্কা বিজয়ের প্রতিশ্রুতির মত ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু এরও পরিণতি শুভ হল না। শহরে ঢুকে মুক্তিফৌজদের প্রথম গুলী যার বুক বিদীর্ণ করল, তিনিই হলেন সেই মহিউদ্দিন আযমী। এ ছাড়াও মওলানা হেদায়েত উল্লাহসহ আরো পাঁচ-ছয় জনের শাহাদতের খবর আমার কাছে এসে পৌঁছল।
ওদিকে রাত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে একটি খসড়া চুক্তিপত্র প্রণয়ন করা হয়। এতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ মাযহারুল ইসলাম এবং আমাদের পক্ষ থেকে আমি স্বাক্ষর দান করি। আমাদের প্রতি ডাক্তার সাহেবের ছিল অন্তহীন সহানুভূতি।
আত্মীয় পরিজন, জামায়াত নেতৃবৃন্দ ও আরো অনেকেই আমার সাথে সাক্ষাৎ করে নিশ্চিত মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিলেন। তারা বলেন নিরাপদ আশ্রয়ে আমাকে সরে যাওয়ার জন্য। জাতীয় বৃহৎ স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমার জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার উল্লেখ করলেন। এ সত্ত্বেও আমার মন সাড়া দিল না মোটেও। কেননা আমার শত শত জানবাজ সহকর্মীদের অনিশ্চিতের মধ্যে ফেলে যেতে বিবেক সায় দিল না। আমি আমার নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও রয়ে গেলাম।
সকালে এলাকার ৩০জন নেতৃবৃন্দসহ ডাক্তার মাযহার সাহেবের বাসায় সমবেত হলাম। তার চোখে মুখে চিন্তা আর উদ্বেগের ছায়া। কিন্তু ম্লান হেসে বারবার তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন। তার চাওনিতে দুঃচিন্তার স্পষ্টতা দেখে মনে হল সম্ভবত তিনি মুক্তিফৌজদের ওপর ভরসা করতে পারছেন না। কেননা তিনি শহর ঘুরে দেখে এসেছেন, মুক্তিফৌজরা শত শত মানুষকে শহরে ঢুকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছে। মনে হল তিনি ভাবছেন, তাকে উপেক্ষা করে তার আশ্রিত ব্যক্তিদের উপর হয়তো বা মুক্তিফৌজ চড়াও হতে পারে। আমি বললাম, ডাক্তার সাহেব, আমাদের চাইতে সম্ভবত আপনি নিজেই অসহায়ত্ব অনুভব করছেন বেশী। আপনার অনেক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না। এর চেয়ে মুক্তিফৌজ চড়াও হবার আগে আপনি আমাদেরকে হিন্দুস্তানী বাহিনীর কাছে সমর্পণ করে দিন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডাক্তার সাহেব আমার কথা থেকে যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। আমার কথাগুলো তার পছন্দ হল। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ভারতীয় কর্ম-কর্তাদের নিকট টেলিফোন করলে সেনাবাহিনী এসে আমাদেরকে তাদের হেফাজতে নিলো। তখন সম্ভবত বেলা ২টা হবে। হিন্দুস্তানী সৈনিকরা আমাদেরকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে তাদের হেফাজতখানার দিকে নিয়ে চললেন। পথে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সাথে দেখা হল। তারা সম্মানিত নেতা মওলানা আতাহার আলীর পায়ে ধরে সালাম করলো, এদের অন্যতম ছিলেন ক্যাপটেন মতিউর রহমান। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর। যাই হোক, ইতোমধ্যে আমরা সরকারী হাইস্কুলে এসে পৌঁছলাম। এখানকার কমনরুমে সেনাবাহিনীর হেফাজতে আমাদের রাখা হল।
আছরের সময় ন্যাপের একটা দলকে আমাদের অবস্থানের দিকে আসতে দেখলাম। এরা প্রত্যেকেই চাদর গায়ে দেয়া। কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, আলবদর কমাণ্ডার কোথায়? আমি বেরিয়ে এলাম। আমার বাহিনীর গ্রপ কমাণ্ডার জাকির ভাইকে ডেকে বাইরে আনা হল। প্রত্যেকের চাদরের মধ্য থেকে লোহার রড বেরিয়ে এলো। শুরু হল লোহার রড দিয়ে নির্মম নির্যাতন। জাকির ভাইয়ের মাথা ফেটে দর দর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। রক্তস্নাত হয়ে উঠলেন জাকির ভাই। আমার উপর চলতে লাগল একই নির্যাতন। একজন আঘাতের পর আঘাত করে ক্লান্ত হলে আর একজন শুরু করে। এভাবে ক্রমাগত নির্যাতন আমার শরীর নেতিয়ে পড়ল। ডান হাতে পেলাম প্রচণ্ড আঘাত। জাকির ভাইয়ের মত আমার মাথা হয়তো ক্ষত-বিক্ষত হবে এমন আশঙ্কা করে আমি বাম হাতে লোহার রড চেপে ধরলাম। তিন চার জনে টানা-হেঁচড়া করেও ওরা আমার হাত থেকে রড ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হল না। ইতোমধ্যে হিন্দুস্তানী সেন্ট্রী এসে পড়ায় আমি নিষ্কৃতি পেলাম। ওদিকে আর এক দল হলের ভেতর প্রবেশ করে মওলানা আতাহার আলী সাহেবের মাথা ফাটিয়ে দিল। তিনিও নিমিষে রক্তস্নাত হয়ে উঠলেন। আর একজন নির্যাতন চালিয়ে এডভোকেট বদরুজ্জামানের হাত ভেঙ্গে দিল। মুসলিম লীগ নেতা এমপি ও পৌরসভার চেয়ারম্যান জনাব আবদুল আওয়াল সাহেবের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হল। এতে তার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। তার সুস্থ হতে অনেক দিন সময় নেয়। বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ পৌরসভার চেয়্যারম্যান এবং জনপ্রিয় এমপি। সোলাইকার চেয়ারম্যান তারামিয়া ও তার বড় ভাই বাদশাহ মিয়ার ওপর নির্যাতন যেমন নিষ্ঠুর তেমনি ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। উভয়েরই পুরুষাঙ্গ দড়ি দিয়ে বেঁধে সিলিং ফ্যানের সাথে সংযোগ করে সেটা পূর্ণ গতিতে চালিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে তাঁদের আর্তচিৎকার ও আহাজারিতে কারবালার ভয়াবহতা প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁদের প্রস্রাবের সাথে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। মোটের উপর আমরা সবাই সেইসব জাহেল বুজদীল ও কাপুরুষের খেলার সামগ্রীতে পরিণত হই।
রাত এগারটা। ন্যাপের নেতৃবৃন্দকে আমাদের অবস্থানের চারিদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হান্নান মোল্লা আসগর ভাইয়ের কাছে এসে বলল, যা করেছেন তার প্রায়শ্চিত্য আপনাদের পেতে হবে। সম্ভবত হান্নান মোল্লা আসগর ভাইয়ের ক্লাসমেট বলে সে তার উপর নির্লজ্জ আক্রমণ চালাতে পারেনি।
অন্যদিকে মোমেনশাহী জেলা ন্যাপের সহ-সভাপতি কাজী আবদুল বারী ও তার সহকর্মীরা বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করে চিৎকার করে বলতে থাকে, অষ্টগ্রামের আমিন ও দৌলত মওলানা কোথায়? হান্নান মোল্লা আমাদের কক্ষ থেকে জবাব দিল না এখানে নেই, এখানকার সকলেই শহরের। সম্ভবত সে আমাদের চিনতো না। দৌলত মওলানা আমার কানে কানে বললেন- আমিন বলে ফেলি যে আমরা এখানে আছি। কাপুরুষের মত লুকিয়ে থাকতে মন চাচ্ছে না। আমি তাঁকে নিষেধ করলাম। সবাই যেন নির্যাতন দেখে দেখে এবং মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কাজী বারীরা চলে গেল। পরে জানতে পারি, অষ্টগ্রামে জনসভা করে তারা জনগণকে আমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে। কাল্পনিক স্বর্গরাজ্যের প্রত্যাশায় মাতাল মানুষগুলোর কাছ থেকে আমাদেরকে প্রকাশ্য ফাঁসী দেয়ার সপক্ষে সম্মতি আদায় করেছে।
রাত ১১টার দিকে মওলানা আবদুল হালিম পাকুন্দিয়া ও ক্যাপটেন মতিউর রহমান এলেন। তাঁরা উভয়েই মওলানা আতহার আলী সাহেবকে সহানুভূতি জানালেন। মওলানা আবদুল হালিম সাহেব তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্ভবত মওলানাদের মধ্যে পাকুন্দিয়া সাহেবই ভারতীয় বাহিনীর সহযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু কেন, তা আমার জানা নেই। তবে তাঁর প্রতি কারো অশ্রদ্ধাও দেখিনি।
ক্যাপটেন মতিউর রহমান আমার পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বললেন- দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সোচ্চার, সে জামায়াত কি করে ইয়াহিয়ার নিপীড়নের সহযোগী হতে পারল! তাঁর ঐ বক্তব্য থেকে আমার মনে হল জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ডের ওপর ক্যাপটেন মতিউর রহমানের ধারণা স্বচ্ছ। অন্তত একটা ব্যক্তিকে আমি পেলাম, সীমাহীন রাজনৈতিক ধূম্রজালের মধ্যেও যার অন্তরে রয়েছে সচেতন বিবেকের এই ক্ষীণ স্পন্দন। আমি জানি, আজ নয়, সময়ের আবর্তে একদিন বিবেকের এই ক্ষীণ স্পন্দনই বেগবান হয়ে উঠবে। আমি কোন জবাব না দিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকলাম। এরপর এলেন SDO খসরুজ্জামান। তার সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। ১৯৭০ সালে আমি যখন ভৈরব কলেজের ছাত্র এবং ভৈরব ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি, তখন SDO খসরুজ্জামান ভৈরব প্রেসক্লাবের উদ্বোধনকালে প্রধান অথিতির ভাষণ দিতে গিয়ে আলেম সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলেন, পাকিস্তান আন্দোলন অথবা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলেম সমাজের কোন ভূমিকা ছিল না। শুধু তাই নয়, তিনি আলেম সমাজকে পরগাছা হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালান। আমি প্রেসক্লাবের সদস্য হিসেবে এর প্রতিবাদ জানাই। যাই হোক, তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে জনাব খসরুজ্জামান কিশোরগঞ্জের ব্যাংকসমূহ লুট করে ভারত পলায়ন করেন।
তিনি আমার বন্দী কক্ষে প্রবেশ করে উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে বলেন- আমিন কোথায়? আমি দাঁড়ালে তিনি বলেন, দুপয়সার ইসলামের জন্য জিহাদ করেছিলেন। এখন আমার হাতে পিস্তল থাকলে গুলী করতাম। মওলানা আতহার আলী সাহেবের উদ্দেশ্যে বলেন- শিয়ালের কান্না গেল কোথায়? শিয়ালের কান্নায় পাকিস্তান রক্ষা হল না? ঘৃণা হয়, এদের মুখ দেখতে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জনাব খসরুজ্জামান ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মোজাফ্ফর ন্যাপের সাথে জড়িত হন।
সেই একই রাত্রে মুক্তিফৌজ আমার ৫শ টাকা জুতা মাফলার আর হাতঘড়িটা নিয়ে গেল। এছাড়াও যার কাছে যা ছিল সবই তারা জোর করে ছিনিয়ে নিল। সকালবেলা আমরা হিন্দুস্তানী ফৌজদের জানালে তারা সেই সব মুক্তিফৌজদের কাছ থেকে অপহৃত টাকা পয়সা ও জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু সেসব কোন দিনই আর ফিরে আসেনি। আমরা জানতাম কোন দিন ওসব আর ফিরে আসবে না। তথাকথিত আন্দোলনের শুরু থেকে দিনে দিনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে যে লুট করার মানসিকতার সৃষ্টি করা হয়েছে, এমন কোন যাদুর কাঠি নেই যা দিয়ে এ মানসিকতার আমূল পরিবর্তন সম্ভব। অবাঙালীদের সম্পদ লুট করার মধ্য দিয়ে কর্মীদের বিবেককে কেড়ে নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তারা গ্রাম-গঞ্জের নিরীহ মানুষের সম্পদ লুট করে। লুট করে অগণিত কুমারী মেয়ের ইজ্জত। পক্ষান্তরে আমরা বিশেষ করে আলবদরদের কথা বলছি, সাধারণ কর্মীদেরকে কড়া দৃষ্টির মধ্যে রাখতাম। কোন দুর্বলতা কোন অভিযোগ কোনভাবে এসে পড়লে তড়িঘড়ি এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হত। এমনকি আমাদের চোখের সামনে কারো দ্বারা কোন অঘটন ঘটলে তার প্রতিকার করেছি আমরা নিজেরাই।
যাই হোক, একদিন ছাত্রলীগের ভিপি আফজাল জানিয়ে গেল, তার ভাষায় 'বঙ্গবন্ধু' ফিরে আসলে বিচার করা হবে। কাউকে আর মারা হবে না। তবে লড়াই করলেও আপনাদের ব্যাপারে কোন নোংরামীর দৃষ্টান্ত জানা নেই। অষ্ট্রগ্রামের ফিরোজ সাহেবও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করলেন।
আহতদের আর্তনাদ, দুঃসহ যন্ত্রণা এবং সার্বক্ষণিক মানসিক চাপের মধ্যে একে একে ৩টা দিন পেরিয়ে গেল। আমার মনে হত যেন আমরা ১৬ ডিসেম্বরে মরে গেছি। এখনকার নির্যাতনকে কবরের আযাব বলে আমার মনে হতে লাগল। দলের পর দল এসে আমাদের উত্যক্ত করতে লাগল। জয়বাংলা বলার জন্য চাপ দিতে লাগল। আমাদের কেউ চাপের মুখে সেই ঘৃণিত শ্লোগান উচ্চারণ করেছিল কি না আমার তা জানা নেই। তবে এ সংক্রান্ত একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে আজও পীড়া দেয়।
বন্দীদশার তৃতীয় রাত্রে, সম্ভবত ২১ ডিসেম্বরের রাত সেটি। মুক্তিফৌজের একটি দল এসে উপস্থিত হল। আমাদের বন্দী জীবনের সাথী একজন এ্যাডজুটেন্টকে ধরে নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে। যাবার সময় কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বিদায় নিলেন তিনি। তার সেই বিদায়ই যে শেষ বিদায় এমনটি ধারণা করেনি কেউ। পরে জানলাম জয় বাংলা বলার জন্য তাকে চাপ দেয়া হয়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ক্ষত বিক্ষত করা সত্ত্বেও জয় বাংলা উচ্চারণ করাতে ব্যর্থ হয় নির্মম মুক্তিফৌজেরা। পক্ষান্তরে প্রতিটি বেয়নেট চার্জের সাথে সাথে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর ধ্বনি উচ্চারণ করছিলেন এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদু রাসূল্লাহ (সাঃ
বলতে বলতে তিনি শাহাদাতের ঐশী নেশায় বুঁদ হয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য।
আরও বেশ কটা দিন চলে গেল অন্তহীন আযাবের মধ্যে। এরপর দুজন মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে আসল, একজন সুমুজ আলী আর অন্যজন গিয়াসউদ্দিন। এই গিয়াসউদ্দিন যুদ্ধ শুরু হবার আগে ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী ছিল। তার উপস্থিতি সেই আত্মিক সম্পর্কের টানে কিনা জানিনা; তবে সে আমার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক সংবাদ নিয়ে এসেছিল, যেটা আমার না শুনলেই বোধ হয় ভাল ছিল। তার কাছ থেকে জানলাম, আমার ফুফা মধুমুন্সী যিনি ২৫ বছর ধরে কখনো ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কখনো সদস্য হয়ে দেশ সেবা করছেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভগ্নিপতি আলাউদ্দিন মোল্লাকে এবং তার চাচাত ভাই মুর্তজা আলী মোল্লাকে গুলী করা হয়েছে। মামা আমান মেম্বার নিহত। ফুফাত ভাই বাদশাহ মিয়াকেও বাঁচিয়ে রাখেনি। অন্য আর এক আত্মীয় জজ মিয়াও আর নেই। এছাড়া আরও অনেক প্রতিবেশীকে নির্মমভাবে হত্যার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে গেল গিয়াসউদ্দিন আমি নির্বাক হয়ে শুনে গেলাম। যেন আমার কানে গলিত লোহা ঢেলে দিল। অসহ্য যন্ত্রণায় আমার দুচোখ বেয়ে ব্যথার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমার মনে হল সম্ভবত ঘাতকরা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার ধারণা এ হত্যার পেছনে সন্ত্রাসী বদর এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুর্তুজ আলী ও সমুজের সক্রিয় হাত ছিল।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে একটা কথা বলতে হয়। গিয়াউদ্দিনের সহযোগী সুমুজ আলী ও বদরের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে ক্রুদ্ধ জনতা তাদেরকে হত্যা করে এবং পরে টুকরো টুকরো করে। পরে আমি লৌহ যবনিকার অন্তরাল থেকে এ খবর শুনতে পাই। নিউটনের তৃতীয় সূত্র যেন বস্তুর সীমা পেরিয়ে নৈতিকতায় এসে পড়েছে। এই সূত্রে বলা হয়, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমমুখী ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আল-কোরআনের সূত্রে বলা হয়, 'আমি যদি জালেমকে দিয়ে জালেমকে শায়েস্তা না করতাম তাহলে পৃথিবীটা জুলুমে পরিপূর্ণ হয়ে যেত।'
আমাদের সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সরকারী স্কুল থেকে পিটিআই-এ স্থানান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। মুক্তিফৌজ ও যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্টদের মন-মানসিকতায় এমন একটা কমপ্লেক্সের সৃষ্টি হয় যাতে আমাদেরকে শারিরীক মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে তারা মানসিক সুখ অনুভব করতে থাকে। তাদের বিবেক আর অনুভূতি এমনই পাথরে পরিণত হয় যে, সাধারণ সৌজন্য ও মহানুভবতা এবং উত্তম চিন্তা-চেতনার একটুও অবশিষ্ট ছিল না। যাই হোক, পিটিআই-এ আমাদের নিয়ে যাবার সময় বন্দীদের দুটো সারিতে দাঁড় করানো হল। একটি সারির সম্মুখে দাঁড়াতে হল আমাকে। অন্যটির সামনে দাঁড় করানো হল শ্রদ্ধেয় মওলানা আতাহর আলী সাহেবকে। আমাদেরকে সরকারী স্কুল থেকে পিটিআই-এর দিকে হাঁটতে বলা হল। মুক্তিফৌজদের ধারণা ছিল, রাস্তার দুপাশ থেকে বিক্ষুদ্ধ জনতা ক্ষোভ, ঘৃণা, ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের উক্তি দিয়ে আমাদের লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু সেটা আর হল না। প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম এর উল্টো। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের চোখ দেখলাম অশ্রুসজল। কারো মুখে কোন কথা নেই। এমন কি শিশুরাও বোবার মত দাঁড়িয়ে আছে। এরা ছিল আমারই প্রতিষ্ঠিত শিশু প্রতিষ্ঠান শাহীন ফৌজের সদস্য। আমার মনে হতে লাগল, ১৭৫৭ সালে সিরাজের স্বপক্ষে যারা সত্যিকারভাবে লড়াই করেছিলেন তাঁদেরকেও ইংরেজ ও তার দালালেরা এমনি করে জনতার সামনে দিয়ে নিয়ে গেছে। ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলনের সিপাহীদের করুণ পরিণতি দেখতে হয়েছে এদেশের নিরুপায় মানুষকে।
জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ। দিনটা ঠিক আমার মনে নেই। কোন এক সকালে দেখলাম কয়েকজন সাবেক ইপিআর অর্থাৎ বর্তমান বিডিআর এর সদস্য আমার কক্ষে এসে আমাকে বলল, আপনাকে ব্যারাকে তলব করা হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে গেলাম। তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছি। যদিও তারা কেউ আমার গায়ে হাত তুলেনি কিন্তু বিভিন্ন কটাক্ষপাতের অবতারণা করে সারাটি পথ মানসিক যন্ত্রণা অব্যাহত রেখেছিল। অবশেষে স্টেডিয়ামের সন্নিকটে এসে পথচলা ক্ষান্ত হল। আমাকে নিয়ে আসা হল সামরিক বাহিনীর অস্থায়ী ব্যারাকে। একটি কক্ষে লেফটেন্যান্ট কামালের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি দেখলাম কামাল সাহেবের চোখে মুখে ভয়ংকর আক্রোশ আর ক্ষোভের চিহ্ন। মনে হল, কোন বিশেষ মহল থেকে আমার বিরুদ্ধে তার কানে বিষ ঢালা হয়েছে। আমাদের নিয়ে কামাল সাহেবদের মানসিক ভীতিও কম ছিল না। এতক্ষণ পিস্তলটা তার বালিশের কাছে ছিল। আমাকে দেখে তিনি তড়িঘড়ি হাতে নিয়ে পেছন দিকে সরিয়ে দিলেন। পরে আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, তোমাদের কাউকে হত্যা করা হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব ব্রীজ কালভার্ট নষ্ট হয়েছে, আমরা চাই তোমাদের হাতেই সেসব মেরামত অথবা নির্মাণ হোক। আমি নীরব থাকলাম। এ প্রসঙ্গে আমার অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি প্রকাশ না করলেও মনে মনে বলেছিলাম, 'তোমাদের সমস্ত গুনাহর কাফফারা মৃত্যুর দোর-গোড়ায় এসেও আমাদের দিতে হবে, সে আমরা জানি। তোমরা ধ্বংস করবে আমরা গড়ব। তোমরা বিদেশীদের দালালি করবে আর দালাল হিসেবে চিহ্নিত হব আমরা। যুগে যুগে ইসলামের সৈনিকরা সমগ্র জাতির ভুলের মাশুল দিয়েছে তাদের জীবন দিয়ে।'
লেঃ কামাল বললেন, 'তুমি অনেক হত্যাযজ্ঞের নায়ক। আমি নীরব থাকলাম। কেননা তাদের আবেগের কাছে আমার সমস্ত প্রতিবাদ ও বক্তব্য অরণ্যেরোদন মাত্র। জিজ্ঞাসা করলেন,তুমি কোথায় লেখাপড়া করতে? বললাম, 'ভৈরবের হাজী আছমত কলেজে। জিজ্ঞেস করা হল, প্রিন্সিপাল তোমাকে জানেন? বললাম জানেন। তিনি তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করলেন। সম্ভবত ভাইস প্রিন্সিপাল হানিফ সাহেব টেলিফোন রিসিভ করেছিলেন। তার সাথে আমার প্রসঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা হয়। তিনি কি বলেছিলেন আমি জানিনা। তবে লেঃ কামালের চেহারায় পরিবর্তন হতে আমি দেখেছি। রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মালেককে চেনেন? বললাম, জ্বি হ্যাঁ, শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক তিনি। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে তাকে শহীদ করা হয়। আমি লক্ষ্য করলাম তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন। আমাকে সম্বোধন এতক্ষণে তুমি থেকে আপনিতে পরিবর্তন হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিকে আমাকে টুলে বসতে দেয়া হয়। আমি বসিনি, দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। কামাল সাহেব চেয়ার এগিয়ে দিলেন। আমি বসলাম। তিনি বলে চলেছেন, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি মালেককে জানতাম। খুব ভাল ছাত্র, তার মৃত্যুতে আমরাও আহত হই, যদিও আমি ছাত্র ইউনিয়নে ছিলাম। আমি বুঝতে পারি না, কি অন্ধ মোহে আপনারা এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছিলেন। ৮ কোটি মানুষের গণস্রোত ও প্রচণ্ড গতির সামনে কি করে আপনারা শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই গতি পাল্টে দেওয়ার জন্য, ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হই। অথচ আপনারা লুট করেছিলেন এমনটিও নয়। বৈষয়িক সুবিধাভোগীও আপনাদের বলা যাবে না। আপনারা আলবদরে যারা রয়েছেন তারা চিন্তা-চেতনার ও যোগ্যতার নিরিখে বিচার করলে পেছনের সারি নন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আপনারা আজ অন্ধ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন! আমি নীরব শ্রোতার মত শুনে গেলাম। এরপর আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসলেন তিনি। আমার পারিবারিক সমস্ত কিছু জানতে চাইলেন। আমার জবাবে পরিবারের যে ছয় জন নিহত হয়েছেন সে প্রসঙ্গ অনুক্ত রইল না। এরপর কামাল সাহেব বললেন, গণবিরোধী ভূমিকা নেয়ার জন্য আপনার সমস্ত পরিবারকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। হয়তো বা আপনাকেও আপনার জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হবে। আপনার কি মনে হয় না যে আপনি একটা বিরাট ভুল করেছেন?
আমি বললাম, আবেগ-তাড়িত হয়ে আমি কিছু করেছি বলে মনে হয় না। আমি যা করেছি অনেক চিন্তা ভাবনার মধ্য দিয়েই। আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক কি বেঠিক এটা নিরূপনের সময় এখনও আসেনি, আগামী দিনের ইতিহাস আমাদের ভূমিকা কিভাবে নিবে সেটাই বড় কথা। তবে এটা ঠিক, মুসলমান হিসেবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার সামনে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল না। নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়ার পথও ছিল বন্ধ। একটা পথ খোলা ছিল, ভারতে পাড়ি জমানো। হ্যাঁ সেখানে গিয়েও আমরা বিরাট দায়িত্ব পালন করতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে কোনদিন সম্ভব হতো না। কেননা হিন্দুস্তানী সাহায্যকে আমি ঘৃণা করি। মুসলমানদের সাথে তাদের হাজার বছরের বৈরী মানসিকতার আকস্মিক পরিবর্তন মোটেও শুভ মনে করতে পারি না। ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের দুর্বল করাই তাদের লক্ষ্য। মীরজাফর ইংরেজদের সহযোগিতায় সিরাজের পতন ঘটিয়ে নিশ্চয় মুসলমানদের জন্য, এমনকি তার জন্যও কোন কল্যাণ ডেকে আনেনি। ইতিহাসের একই ভুলের আবর্তে আমি পা রাখতে চাইনি।
যখন পরিস্থিতি আমি অবলোকন করছি কোন পক্ষ অবলম্বন না করে, আমি যখন আমার অঞ্চলের মানুষগুলোকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচাবার চিন্তা-ভাবনায় নিরত, ঠিক সে সময় কয়েকবার মুক্তি বাহিনী আমার বাড়ীতে হানা দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এর ফলে সাম্প্রতিক ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে তৃতীয় কোন অবস্থান নেয়ার পথ আমার জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। কাপুরুষোচিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মন-মানসিকতা কোনকালেই আমার ছিল না। আমি সঠিক বিচারে মন্দের ভাল হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সঠিক পথ মনে করে একাত্তরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। এখন আমরা একতরফা প্রচারণার শিকার।
দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে লেঃ কামাল আমার খাওয়া-দাওয়া প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, এ কয়দিন আমি ভাত খাইনি। অসুস্থতার অস্বস্তিতে আমি বিব্রত ছিলাম। আমার সহযোগী ভাইয়েরা কোথায় কিভাবে বাইরে থেকে খাবার ম্যানেজ করতেন, সেটা আমার জানা নেই। এসব খেয়েই রয়েছি এ কয়দিন। কামাল সাহেব বললেন, আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করি, কি বলেন?; আমি দ্বিমত পোষণ করলাম না। আমাকে বাবুর্চিখানায় পাঠিয়ে দিলেন। আমি খেতে বসলাম। মনে হল আমি কতকাল খাইনি। আর সত্য বলতে কি এ কয়দিন গোস্ত খাওয়াতো দূরের কথা চোখেও সেসব দেখিনি। আমি পরম তৃপ্তিতে খেলাম। ভাতের চেয়ে গোস্ত খেলাম বেশী। এরপর ফিরে এলাম আবারও কামাল সাহেবের চেম্বারে। এসে দেখলাম এখানে কেউ নেই। আমি বসে থাকলাম। কামাল সাহেব ফিরে এসে কিছুটা আমার সাথে সহানুভূতিসুলভ হাল্কা আলাপ শুরু করলেন। ইতোমধ্যে হিন্দুস্তানী বাহিনীর ২ জন অফিসার এলেন। কামাল সাহেব তাদের অভিনন্দন জানিয়ে আমাকে নিয়ে তাদের সাথে হাসি-মশকারায় অবতীর্ণ হলেন। এক পর্যায়ে আমার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার পরিচয় দিতে গিয়ে অনেক হত্যাযজ্ঞের নায়ক আমি- এ কথা বলতে ভুললেন না। আমার মনে হল ভারতীয় অফিসাররা রাজপুত। তাঁরা কখনো হিন্দীতে কখনো ইংরেজীতে কথা বলছিলেন। তারা আমাকে বললেন, বাংলাদেশের হাজার হাজার প্রগতিশীল ছাত্র ভারতে ট্রেনিং নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তা সত্ত্বেও আপনি কেন দেশে রয়ে গেলেন? বললাম, আমি ভারতকে কখনও হিতাকাঙ্খী মনে করিনি।
তারা বললেন, আপনার ধারণা ছিল পাকিস্তান টিকে যাবে এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বৈষয়িক সুযোগ সুবিধা নেয়ার ব্যাপারে সংঘাতকালীন ভূমিকা আপনার জন্য হবে একটি বিরাট সার্টিফিকেট। বললাম, বৈষয়িক লোভ লালসার বাইরে থেকে আমরা আমাদের ভূমিকা রেখেছি। শুধুমাত্র ঈমানের দাবী আমার কাছে যা ছিল তাই করেছি। এর বাইরে চিন্তা করার কোন অবকাশই আমাদের ছিল না এবং এখনও নেই।
- আপনি কী করতেন?
- ছাত্র ছিলাম। ছাত্র হিসেবে ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য ছিলাম।
- আপনি কতজন লোক হত্যা করেছেন?
- রণাঙ্গনে কতজন মরেছে সেটা আমার জানা নেই, আমি প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে ছিলাম না। সার্বিক পরিচালনা করেছি। নিজে গুলী চালানোর অবকাশ আমার ছিল না। তবে যুদ্ধ চলাকালীন কেউ নিহত হয়ে থাকলে তার দায়-দায়িত্ব আমারই, কেননা আমার নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। কতজন মারা গেছে সেটা আমাদের চাইতে আমাদের প্রতিপক্ষরাই সঠিক বলতে পারবে। লড়াইয়ের ময়দানে হতাহতের ব্যাপারটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়।
তারা বললেন, আপনাদের গ্রামে-গঞ্জে এবং মহকুমা শহরে যে প্রাচুর্য আমরা দেখেছি, আমাদের জেলা শহরগুলোতেও তেমন নেই, তা সত্ত্বেও এখানকার তরুণরা বিদ্রোহী হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হল কেন এটা এখনও আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি এ প্রসঙ্গে নীরব থাকলাম। কামাল সাহেবকে দেখলাম তার দৃষ্টি নিচের দিকে। মনে হল, তাদের জন্য এটা একটা চপেটাঘাত। এরপর কামাল সাহেবের চেম্বার থেকে বিদায়ের পালা। সবাই একত্রে বেরুলাম। লেঃ কামাল আমাকে তার গাড়ীতে উঠতে বললেন। আমাকে আমার সেই অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে তারা চলে গেলেন। আমি আমার সেই হল কক্ষে ঢুকে দেখতে পেলাম অনেকের অশ্রুসজল চোখ। মওলানা আতাহার আলী সাহেবসহ আমার সব সহযোগী অধীর আগ্রহে আমার সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে পেয়ে যেন তারা আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তাদের ধারণা ছিল আমাকে আর তারা পাবে না। পাবে সেই এ্যাডজুটেন্টের মত আমার শাহাদতের সংবাদ। এতক্ষণ তারা দোয়া ইউনুস পড়ে আমাকে জীবন্ত ফিরে পাওয়ার জন্য খোদার কাছে কান্নাকাটি করছিল। হয়তো আমার সেই সহযোগী আল্লাহর নির্যাতিত বান্দাদের দোয়ার বরকতে ফিরে আসতে পেরেছি। মজলুমের দোয়া নাকি আল্লাহ্ সাথে সাথে কবুল করেন। অনেকে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাদেরকে সমস্ত বিবরণ খুলে বললাম।
আর একদিন এক কালের আমার সহকর্মী বর্তমান মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার গিয়াসউদ্দিন এসে উপস্থিত হয়ে আমার কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করল এবং বাড়ীর খবরাখবর দিল। গিয়াসউদ্দিন এও জানালো যে, আমার মা আমার জন্য কিছু খাবার তাকে দিয়েছিলেন আর দিয়েছিলেন আমার পরনের কাপড়। সেসব আমার অবস্থান পর্যন্ত এসে পৌঁছেনি। সে বলল যে, তার সহযোগীরা সব জামা কাপড় নিয়ে গেছে এবং খাবারগুলো খেয়ে ফেলেছে। এজন্য তাকে দুঃখ প্রকাশ করতেও দেখলাম। তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। এজন্য তাকে অন্যান্যদের কাছ থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলতে গেলে কানে কানে বলেছিলাম, তুমি বরং আমার খালু মীর আশরাফ উদ্দিন আহমদ চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় যাও। ওখানে আমার জামা-কাপড় রয়েছে। সে সবের কয়েকটা আমাকে এনে দিলে আমার দারুণ উপকার হবে। তুমি আমার এ কাজটা করেই বরং বাড়ী যেও। এক জামা-কাপড়ে দারুণ বিব্রতবোধ করছি। নামাজ কালামেও তৃপ্তি পাচ্ছি না। গিয়াসউদ্দিন সেসব আমাকে এনে দিতে সম্মত হল। কিন্তু সে জামা-কাপড়ের একটিও আজ পর্যন্ত আমার হাতে এসে পৌঁছেনি। আমার স্যূটকূট জামা-কাপড়, জুতা, সেন্ডেল আর গেঞ্জী পরে তারা সদলবলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু গিয়াউদ্দিনের পরনে সেসব কাপড় আমি দেখেনি। তার ভাষায়, আমি আর সকলকে এড়িয়ে আপনার জিনিস পৌঁছাতে পারিনি। আমি অসহায়ের মতো নীরবে তাকিয়ে থাকলাম। সবচেয়ে করুণ ও দুঃসহ নির্মমতার প্রকাশ ঘটাতেও তারা ছাড়েনি। আমার পাশের গ্রামের এক তরুণীর সাথে আমার বিয়ের কথা আমাদের গার্জেন পর্যায়ে মোটামুটি ঠিক হয়েছিল। সেই তরুণীকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বন্দুকের নলের মুখে বিয়ে করে এবং সেই বিয়েতে খালুর বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া সুটকেসটি উপহার দেয়া হয়। এসব ঘটনাসমূহের অবতারণা করা হয় আমাকে এবং আমার মা ও আত্মীয় পরিজনদের মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার জন্য।
কিছুদিন পর আমাকে কিশোরগঞ্জ জেলে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করা হয়। সোজা পথ দিয়ে অথবা গাড়ীতে জনমানুষের প্রদর্শনী ছাড়াও আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু সেটা না করে আমাকে কলেজের পাশ দিয়ে বিভিন্ন পথ ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। এর একমাত্র কারণ, যেন আমি বিভিন্নভাবে জনতার হাতে লাঞ্ছিত হই। আমি যেন এখন এক খেলার সামগ্রী। আমাকে ঘিরে জনমানুষের ভিড় সৃষ্টি করাই হল পুলিশদের উদ্দেশ্য। কলেজের ছাত্ররা আমার প্রতি বিদ্রুপাত্মক উক্তি করুক এমনটি চেয়েছিল পুলিশেরা। কিন্তু সেটা হল না। পথিমধ্যে শুধুমাত্র কতিপয় কলেজ ছাত্রীর মন্তব্য আমার কানে এসেছিল। তা হল, আলবদরের পান্ডাকে দেখ, নিয়ে যাচ্ছে। এরা আমাকে জানতো। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের স্বপক্ষে ভাষণ দিতে দেখেছে। কারাগারের সম্মুখে দেখলাম অনেক মানুষের ভিড়। সকলে আমাকে দেখার জন্য সমবেত হয়েছে। আলবদরকে দেখার এমন আগ্রহ দেখে মনে হল, আমি যেন কোন এক ভিন গ্রহ থেকে এসেছি। এ দেশ এ মাটির সাথে আমার যেন কোন সম্পর্ক নেই অথবা কোনদিন ছিল না। সম্ভবত পত্র-পত্রিকার উদ্ভট প্রচারণা থেকে মানুষের আগ্রহ এমন তীব্র হয়েছে।
অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্য দিয়ে আমাকে জেলের ভেতরে পা রাখতে হল। ভেতরে ঢুকিয়েই অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে একটা সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আমার মনে হল গোটা দেশটা একটা কারাগার। সেই করাগার থেকে ছোট, ছোট থেকে অতি ছোট কারাগারে প্রবেশ করলাম, আওয়ামী লীগের ঔদ্ধত্বের কাছে অসহায় কারা কর্তৃপক্ষের মেহেরবানীতে। এখানে আমাকে নিয়ে দাঁড়াল ৭ জন। অথচ খুব বেশী হলে স্থান সংকুলান হয় ৩ জনের। এখানে যারা ছিল, যদিও এরা মানুষ কিন্তু তাদের চাল-চলন, আলাপ আলোচনা ও তাদের সমস্ত অভিব্যক্তি থেকে মনে হত এরা নর্দমার কীট। গনোরিয়া সিফিলিসের রুগী এরা। সারাক্ষণ তাদের আলাপ আলোচনায় সারা জীবনের অপকর্মের ফিরিস্তি একে অপরের কাছে অকপটে প্রকাশ করছে। এদের সাথে আলাপ আলোচনা অথবা কোন রকম কথা বলার আগ্রহ কোন সময়েই আমার জাগেনি। আমি ৬টি লোক সাথে পেয়েও একান্ত একা। নির্লিপ্ত হয়ে সারাক্ষণ বসে অথবা শুয়ে কাটাতম, আমার জীবন মৃত্যু যার হাতে, সেই মালিকের রহমত কামনা করে। পরে জেনেছিলাম, এই অন্ধ প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করানোর মূলে ছিলেন আমারই মত ২জন বন্দীর বিভ্রান্তিকর প্রচারণা। তারা হচ্ছে শান্তি কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মহকুমা অফিসার ও মুসলিম লীগ নেতা বাদশাহ মিয়া। তারা কারা কর্তৃপক্ষ ও আওয়ামী লীগের করুণা ও রহমতের প্রত্যাশায় আমাকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ধারণা দিয়েছিল, সমস্ত অপকর্মের নায়ক আমি। অথচ তাদের প্রকোষ্ঠে আর একজন থাকতেন এডভোকেট সাইদুর রহমান আরো অনেকে। তারা আমাকে নিয়ে কোন খারাপ ধারণা ব্যক্ত করেননি। বরং আমার প্রতি ছিল তাদের গভীর মমতা।
ছয় জন কারাসঙ্গী থাকা সত্ত্বেও আমি একা। আমার একাকীত্ব আমাকে নিমগ্ন করেছে পুরোপুরি। আমার ফেলে আসা বিক্ষিপ্ত স্মৃতিগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছি। আর আত্মবিশ্লেষণ করে চলেছি সারাক্ষণ। মনের পর্দায় ভেসে উঠছে...।
সত্তরের নির্বাচন শেষ। রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেশটা যেন দুটো ভাগ হয়ে গেল। একদিকে উগ্র আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ অন্যদিকে ইসলামী সমাজতন্ত্রের ইউটোপিয়া। দুটোরই অবাস্তব কাল্পনিক স্বাচ্ছন্দের প্রতিশ্রুতি আর চোখ ঝলসানো প্রাচারণার তোড়ে সমগ্র জাতিটা দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাতির অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনা যাদের তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল নির্বাচনের রায় ঘোষণার পর তারা নির্বাক হয়ে পড়ল। অতি আশায় উচ্ছল কোটি কোটি মানুষ হল প্রত্যাখ্যাত। এই প্রত্যাখ্যান পর্যায় স্বাভাবিক পথ ধরে হয়েছে এমনটি বলা যায় না। আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের পোষা গুণ্ডাদের দ্বারা আমাদের সহকর্মী বহু পোলিং এজেন্টকে পোলিং বুথ থেকে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্য এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল বলে আমার জানা নেই। এমনটি হবে এটা অনেকেই আঁচ করেছিল অনেক আগে থেকে। ঢালাও পয়সার বিনিময়ে এবং পোষা গুণ্ডাদের উগ্র মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে জাতির বিবেককে কেনার সামর্থ্য আওয়ামী লীগ অর্জন করেছিল। বেশ কিছু আগে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ভাষণ দেয়ার সময় টাকা সংগ্রহের জন্য শত শত ড্রাম বসান হয়েছিল। এ থেকে কত টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। সেটা বলা হয়নি। তবে এর অছিলায় কোটি কোটি টাকার হিন্দুস্তানী মদদ জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবের হাতের মুঠোর মধ্যে এসেছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য। এটা অনেকেই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু বলবার হিম্মত ছিল না অনেকের।
এ প্রক্রিয়া কোন তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। এর শুরু অনেক আগে থেকে। বলতে গেলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে এর মূল উদগাতা আওয়ামী লীগ অথবা শেখ মুজিব কেউই নয়। এর নেপথ্যে যাদের কালো হাত সবচেয়ে সক্রিয় ছিল সেটা হল কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক সংগঠনগুলো। আর এ ব্যাপারে সর্বাত্মকভাবে সুযোগ সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানের প্রতিশ্রুত আগামী দিনগুলোকে নিয়ে শুরু হয় প্রসাদ ষড়যন্ত্র। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে উপমহাদেশের মানচিত্র ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেই দ্বিজাতীয় তত্ত্বকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অস্বীকৃতি জানানোর প্রয়াস অব্যাহত থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনা লগ্নে কোটি কোটি ইসলামী জনতার উদ্দেশ্যে যে বাণী সম্প্রচারিত করা হয়েছিল সেটা হল কায়দে আযমের ভাষায়, আমাদের নতুন শাসনতন্ত্রের প্রয়োজন নেই। ১৪শ বছর আগে এটি রচিত হয়েছে। আমরা তার প্রতিফলন ঘটাব মাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়, এরও কারণ রয়েছে। জনগণের আবেগ ও মন-মানসিকতা ইসলামিক হওয়া সত্ত্বেও নেতৃত্ব যাদের হাতে এসে পড়ে, তারা হচ্ছেন নবাব, জমিদার ও গোলামী মনোবৃত্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত তথাকথিত এলিট গোষ্ঠী। তাদের মন-মানসিকতায় ইসলামী চেতনার ক্ষীণতম আলো বিরাজ করলেও ইসলামী জীবন-বোধ সম্বন্ধে তাদের অন্তঃকরণে সটিক ধারণা অনুপস্থিত ছিল। এর ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ইসলামী জনতার দাবী হয়েছে উপেক্ষিত। তাদের আন্দোলন ও বক্তব্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদানা বলে এমনকি তাদেরকে পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিষোদগার করা হয়েছে বার বার।
আলেমদের মধ্যে অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা মওলানা আবুল কালাম আযাদ ও মওলানা মাদানীর কাতারে টেনে এনে ইসলামের অগ্রনায়কদের ভাবমূর্তিকে খাটো করার জন্য তাদেরকে পাকিস্তানের শত্র ও ভারতের দালাল হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে এদের বিরুদ্ধে গুণ্ডাও লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত পাকিস্তান বিরোধীরা এক পা এক পা করে নেপথ্য যবনিকা থেকে রাজনৈতিক মঞ্চে এগিয়ে আসতে শুরু করে।
জামায়াত যখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবীতে গণআন্দোলন শুরু করার আয়োজন-উদ্যোগ নেয় তখনই ছাত্রদের মাধ্যমে ৬ দফা রাজনৈতিক ময়দানে আনাগোনা শুরু করে। পঁয়ষট্টির যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে মার খেয়ে হিন্দুস্তান পিছন দিক থেকে এ জাতিকে ছুরিঘাত করার চেষ্টা নেয়। ৬ দফা আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করে থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এটা আসে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র*্যাডের টেবিল থেকে সময় মত আগরতলা ষড়যন্ত্রের রহস্য ও উদঘাতি হয়। আওয়ামী লীগ তখন ময়দান থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধু মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম আওয়ামী লীগের নিভু নিভু বাতি জ্বেলে রেখেছিলেন কোন মতে।
ছাত্রদের মধ্যে র*্যাডের এজেন্টরা ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে। তখন রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাদের সহায়ক শক্তি ছিল ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে এরা সিদ্ধহস্ত। গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে, যখন আইয়ুব খানের সাথে বোঝাপড়া হবে, এ সময় ১১ দফাকে আকস্মিকভাবে গণআন্দোলনের জোয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়। বামপন্থী সাংবাদিকতার সুবাদে ১১ দফা ব্যানার হেডিং-এ সবকটি দৈনিকে প্রকাশ পেতে থাকে। এতে ছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা আর বাকীটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রোগ্রাম। রুশ-ভারত ষড়যন্ত্র হাত ধরে পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। এই মোর্চা থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী উঠল। এ দাবীও গণজোয়ারে ছেড়ে দেয়া হল। ফলে ধিকৃত ষড়যন্ত্রের নায়কের মুক্তির দাবীটা জনগণের আওয়াজে পরিণত হতে দেরী হল না। জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দল এটাকে এড়িয়ে যেতে পারল না। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রকারী ভারতের দালাল পরিণত হল জাতীয় হিরোতে।
আল্লাহ আসন্ন বিপদের লাল সংকেত দিয়েছে সময় মত এবং বার বার। তা না হলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে মালেক ভাইয়ের মত চরিত্রবান ও সেরা ছাত্রের শাহাদাত সে সময় হল কেন? অথচ এই আসন্ন ঝড়ের সংকেত বুঝল না ইসলামপন্থীরা। তারা সংঘবন্ধভাবে বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ব্যর্থ হল।
সত্তরের ১৮ জানুয়ারী পল্টন ময়দানে ইসলামী জনতার রক্ত ঝরার পরও ইসলামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারল না। ওটাও ছিল আসন্ন ঝড়ের সংকেত। আমি পল্টনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি কি ভয়াবহ দৃশ্য! একটা কারবালা যেন। শত শত মানুষকে রক্তাক্ত হতে দেখেছি। শহীদও হয়েছে কয়েক জন। অথচ ষড়যন্ত্রকারীরা রাত্রে মাইক যোগে প্রচার করেছে, নিরস্ত্র জনতার ওপর জামায়াতে ইসলামী গুণ্ডাদের নির্লজ্জ হামলা। কি বিচিত্র এদেশ সেলুকাস!
এইভাবে আওয়ামী লীগ তাদের সুপরিকল্পিত প্রচারণা দিয়ে জনতার বিবেককে ধীরে ধীরে অন্ধতার দিকে টেনে নিয়ে চললো। সরকার নিরপেক্ষতার আবরণ দিয়ে তার চোখ দুটোকে বেঁধে রাখলো। আওয়ামী লীগের কালোহাত প্রশাসনকে পর্যন্ত স্পর্শ করলো। সরকারের নীরবতার সুযোগে হিন্দুস্তান আওয়ামী লীগের মাধ্যমে পাকিস্তানে যা কিছু করতে চেয়েছিল তার সবটাই নির্বিগ্নে করতে পেরেছে। এতে মদদ দিয়েছে- সরকার, মদদ দিয়েছে ভুট্টো, মদদ দিয়েছ অন্যান্য সব কটি দল। বলতে গেলে পরোক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামীও।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল ফ্যাসীবাদী কায়দায়। দুই দিকে দুই জাহেলিয়াতী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ালো। মুজিব-ভুট্টো স্পস্ট বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে জনগণকে নিয়ে চললো এক ভয়ঙ্কর সংকটের দিকে। ইয়াহিয়া মুজিবের ষড়যন্ত্র অনুধাবন করল। কিন্তু ভূট্টোকে আন্দাজ করতে ব্যর্থ হল। রাজনীতিতে শুরু হল অরাজকতা। মুজিব-ভূট্টো যা চেয়েছিল দেশ সে অবস্থায় এসে উপনীত হল।
অপরাধ করতে করতে আওয়ামী লীগের দুঃসাহসিকতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। যখন হত্যাযজ্ঞ শুরু হল অবাঙালীদের ওপর, যখন জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার গর্জে উঠল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিকদের লক্ষ্য করে, তখন সরকারের টনক নড়ল। তখন যমুনার পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। গোটা দেশে তখন কারবালা সংঘটিত হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি অবাঙালী বসতি উজাড় হয়ে গেছে। এটাও ছিল হিন্দুস্তানী পরিকল্পনা। অবাঙালী ও ইসলামপন্থীদের হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার নিপীড়ন শুরু হলে স্বাভাবিকভাবে বাঙালীরা হিন্দুস্তানে পলায়ন করবে। তারপর সেখান থেকে পাকিস্তানকে পাকিস্তানী দিয়েই ভেঙে টুকরো করা যাবে।
একই সূত্র থেকে একই পরিকল্পনার পথ ধরে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এগুতে লাগলো। ভূট্টোর দোসর টিক্কা খানের সামরিক অপারেশন ভয়াবহতা সৃষ্টি করলো। দুষ্কৃতিকারী আর প্রকৃত অপরাধীরা ততক্ষণে সীমান্তের ওপারে। নিরীহ সাধারণ মানুষেরা সহানুভূতির বদলে পেল সামরিক অপারেশনের ভয়বাহতা।
এক ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা নিয়ে তখন আমি গ্রামের বাড়ীতে। এখান থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি আঁচ করতে পারছি না। সম্পূর্ণ অন্ধকারে আমি বিদিশা। দেশের ভবিষ্যত নিয়ে দারুন উদ্বিগ্ন। এক নীল নক্সার শিকার হয়ে আমরা দেশের ৮কোটি মানুষ কী সাধ করে হিন্দুস্তানের পায়ের তলে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি!
হিন্দুস্তানের মদদ কি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে? এ প্রশ্ন আমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছি বার বার। এখন আমরা কি করতে পারি? অশান্ত উদ্বেল দেশটাতে কিভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনা যাবে? এমন শত শত প্রশ্ন, শত শত সমস্যার পাঁকে যেন আমি হারিয়ে যাচ্ছি।
আমার এ উদাস উদভ্রান্ত অবস্থা দেখে মা দারুণ বিব্রত বোধ করেছিলেন। মা এক সময় আমাকে বললেন- তুমি এভাবে বাড়ীতে বসে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। যাও বাজারের দিক থেকে ঘুরে আসতো। মার কথায় আমি দ্বিমত পোষণ করলাম না। আমি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছি আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ধরে। সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে। খাঁ খাঁ করছে সবকিছু। দুপাশে কড়োই গাছ ঝিম ধরে আছে। ঝিম ধরে আছে বিশ্বপ্রকৃতি। এত পরিচিত এই পথঘাট, এই এত আপন আমার এ গ্রামটা। এই মাটি, এই ভূখণ্ড যেখানে আমি লালিত হয়েছি, যেখানকার সৌন্দর্য সুষমা পান করে আমি বেড়ে উঠেছি। মাটির সোঁদা গন্ধ আর মউলের সুরভী শুঁকে শুঁকে আমি জীবনটাকে উপলব্ধি করেছি। এই গ্রামবাংলার সাথে আমার কি নিবিড় সম্পর্ক অথচ আমি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে সুস্থ রাজনীতি বিপন্ন। জগতশেঠ আর মীরজাফরের রাজনীতির কাছে মীরমদনের রাজনীতি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম অষ্টগ্রাম বাজারে। এসে ঢুকলাম ভূঁইয়াবাড়ীর চা স্টলে। এখানে লোকজন কম মনে হল না। জমজমাট চা বেচাকেনা চলছে। কিন্তু চেনা মুখ চোখে পড়ছে না আমার সবই যে অপরিচিত মুখ। আমি ভাবছি আমার মানসিক অবস্থা কি সব মানুষকে অপরিচিত করে দিয়েছে? নাকি এরা সব নবাগত! আমি এমন একটা ভাবনার মধ্যে রয়েছি এমন সময় দেখলাম , আমার এক পরিচিত মুখ কাজী বারী। মোমেনশাহী জেলা ন্যাপের সহ-সভাপতি। কোন এক সময় তার কর্মী ছিলাম আমি। অন্ধতার ঘোর কাটলে আমি অবস্থান নিই তার বিপরীত বলয়ে। আমাকে দেখেই কাজী বারী সদম্ভে বললেন- কি আমিন, তোমার সিনা তো বেশ চওড়া হয়ে গেছে। তার কথাটা শুনেই আমার চেতনা ফিরে আসলো। আমি এখন স্পষ্ট বুঝলাম, এ অপরিচিত মুখগুলো এখানে কেন? বুঝলাম আমি আমার অজান্তে শত্রর বেষ্টনীর মধ্যে এসে পড়েছি। ঘটনার আকস্মিকতায় একটা তাৎক্ষণিক বিহবলতা আমার মধ্যে এলেও আমি নিজেকে সামলে নিয়ে একটুখানি চাতুরির আশ্রয় নিলাম। বললাম, বারী ভাই যে। চায়ের দোকানীর উদ্দেশ্যে বললাম-বারী ভাই আর আমার জন্য লাগান ২ কাপ চা। বিস্কুটও দেন, আমি এক্ষুণি আসছি। কাজী বারী আমার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা আঁচ করতে পারল না। আমি কেটে পড়লাম। কিন্তু সমস্ত বাজারটা আমার কাছে মনে হতে লাগলো আমার শত্র। মনে হচ্ছিল সবাই যেন আমার পিছে ধাওয়া করছে। আমি ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলছি। চলার পথে দেখলাম হাফেজ আবদুল হাইও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। চাপা কণ্ঠে বললেন- এখানে কেন। তাড়াতাড়ি সরে যান। ইপিআর, আওয়ামী লীগ আর কমিউনিস্টরা বাজারে ক্যাম্প করেছে। মওলানা আব্দুল গণি খান সাহেবের বাড়ীর সকলকে হত্যা করেছে। এদের টার্গেটে আপনিও আছেন। বাড়ীতেও থাকবেন না। বাজার একটু আড়াল হলে আমি দৌড় দিলাম আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে।
বাড়ী এসেই বাবা-মাকে নিয়ে বসলাম। পরিস্থিতির সমস্তটাই বিশ্লেষণ করে বললাম-আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা নিলেও এরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। এ অবস্থায় আমি কী করতে পারি?
বাবা বললেন- কোন বুজদীলের মৃত্যু মুসলমানের নয়। তোমাকে আল্লাহর রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছি। যে কোন মূল্যে আল্লাহর পথে থাকাই উত্তম। মা বললেন-এই পরিস্থিতিতে তোমার যা ভাল মনে হয় তাই করো। তোমার পথ আগলে রাখতে চাই না।
আমার সে রাত্রে ঘুম নাই। আমি সারা রাত ঘুরে ঘুরে আমার বন্ধু বান্ধব ও নিজস্ব লোকদের সাথে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম সবাই আমার মতই চিন্তা করছে। ভারতীয় প্রচারণার ধূম্রজালে এরা কেউ আটকেনি। নিজস্ব চিন্তার পরিসর দিয়ে সবাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে।
রাত ভোর হয়ে এল। ফজরের নামাজ শেষ করে বাবার কাছে বিদায় নিলাম। আমাকে অনিশ্চিতের মধ্যে ছাড়তে বাবার অন্তর কাঁদছিল। আমি তার মুখে দেখেছি হাসি কিন্তু সে হাসির আড়ালে কি দারুণ বেদনা লুকিয়ে আছে, একমাত্র পুত্র হয়ে সেটা অবশ্যই আমি উপলব্ধি করি। মার চোখ দেখলাম অশ্রুসজল। সূর্য উঠার আগেই আমি গ্রাম ছাড়লাম। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায়, আমি এসে পৌঁছলাম ভৈরব।
২৫ মার্চের পর এই প্রথম পা রাখলাম ভৈরবে। এখানে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। কেমন যেন স্থবির মনে হল। প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা এই ভৈরব যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। একটা প্রচণ্ড ঝড় যেন বয়ে গেছে এই ভৈরবে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি এগিয়ে চলছি। চকবাজারে এসে থমকে দাঁড়ালাম। হাজী সবদের আলী সাহেবের দোকানের ভেতরে ঢুকতেই হাজী সাহেব আমাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ওদের বাঁচাতে পারলাম না। মনসুরের বাবা-মা ভাই-বোনকে বাঁচাতে পারলাম না। ওরা সব শেষ।
আমি তার কথা বুঝলাম না। অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। তিনি বলে চলছেন, এখানকার সব অবাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। মনসুরের বাবা, মা, ভাই বোন সহ ৫শ বিহারীকে ব্রাক্ষ্মবাড়িয়া নিয়ে হত্যা করেছে। মনসুরকে আমার দোতালায় লুকিয়ে রেখে বাঁচিয়েছি। আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে এলো। মনুসর আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, ডিগ্রীর ছাত্র। আজ সে এতিম সর্বহারা। আমার ভেতরের মানবিক সত্তা জেগে উঠল। আমার অন্তরের ঘুমন্ত সিংহ গর্জে উঠল যেন। এইসব জুলুম অত্যাচার আর অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নিলাম। বিভিন্ন সূত্রে আমি জানলাম, এসব অমানবিক হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, মোজাফফার ন্যাপের লেঃ রউফ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নং আসামী
, অধ্যাপক মতীন ও আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক মিয়া। এদের ব্যাপারে আমি চিন্তা করলাম হিন্দুস্তানের প্ররোচনায় এরা কি করে পারলো মুসলমানদের খুনে তাদের হাত রঙীন করতে। কি করে পারলো অবোধ শিশুদের বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে। তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা আর ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হল আমার মনে।
খাঁটি সরিষার তেল আর ঘি বিক্রি করতেন আমাদের সফি ভাই। আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। বললেন, আমিন ভাইয়া আমার বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। আমার আত্মীয় পরিজন সকলকে শেষ করে দিয়েছে ওরা। আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। আমার শপথ আরও প্রচন্ড হয়ে উঠলো।
ভৈরবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আমি সংক্ষিপ্ত একটা ট্রেনিং নিলাম। ইতোমধ্যে সুযোগ-সন্ধানীরা সেনাবাহিনীর আশেপাশে ভিড় জমিয়েছেন। এরাও দেখলাম মোজাফফর ন্যাপের লোকজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের শয়তানী প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আমি প্রতিবাদী হয়ে উঠি। আমার ব্যাপারে সুযোগ সন্ধানী তোষামোদকারীরা সেনাবাহিনীকে ভ্রান্ত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে। এরপর ভৈরবকে আমার জন্য নিরাপদ মনে করলাম না।
আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া চলে এলাম। এখানে সংগঠনের অন্যতম নেতা মুহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে আমার উন্নত ট্রেংনি এর ব্যবস্থা করে দিলেন। ট্রেনিং শেষ করে এখানে বেশ কিছু দিন অবস্থান করি। ইতোমধ্যে আমি বাড়ীর টান অনুভব করতে থাকি। বাবা-মার সান্নিধ্য পাবার জন্য প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। একদিন কুমিল্লার গোয়ালনগর ইউনিয়ন কাউন্সিলের কলিমউদ্দিন চেয়ারম্যানের সাথে গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা হলাম।
আমার ধারণা ছিল এর মধ্যে হয়তো অষ্টগ্রামে পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এসে শুনলাম এখানকার অবস্থা আগের মতই। সশস্ত্র ইপিআর, আওয়ামী লীগ আর বামপন্থীদের চারণভূমি এই অষ্টগ্রাম। গ্রামে আমার আসার সংবাদ ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে পৌঁছে গেছে। এ খবর জানলাম দেলোয়ার মাষ্টার অর্থাৎ দিলু ভাই এর চিরকুটে। আমার হিতাকাক্সক্ষী এবং আমার বিরোধী আওয়ামী লীগের লোকেরা সবাই এসে আমার বাড়ীতে ভিড় জমিয়েছে। সবার কৌতূহলী চোখ আমার দিকে। আমার আসন্ন পরিণতি দেখার জন্য সবাই যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমি আমার দুর্বল অবস্থান আর ভয়াবহ অবস্থা আঁচ করলাম। কিন্তু তাৎক্ষণিক কী করতে পারি! এর মধ্যে হয়তো সশস্ত্র পতিপক্ষরা আমার উদ্দেশে রওয়ান হয়ে গেছে। এত চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথাও লুকানো সম্ভব নয়। হিতাকাক্সক্ষীদের অনেকে জিজ্ঞাসা করছে আমি কেন এলাম। আমার দুর্বলতার প্রকাশ না ঘটিয়ে সকলকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললাম- আমি আমার প্রস্তুতি না নিয়ে এমনি এসেছি, আমি কি এমনই গাধা। দাওনা ওদরে আসতে। আমার চোখে মুখে ভীতি নেই, নির্বিকার অভিব্যক্তি। আমার এ কথায় সম্ভবত কাজ হয়েছিল। প্রতিপক্ষরা তাৎক্ষণিক আমাকে আঘাত হানার সাহস করেনি। ওরা থমকে ছিল। আমার দিক থেকে কোন আঘাতের প্রতীক্ষা করছিল হয়তো বা। তাতে আমি বেশ সময় পেয়ে গেলাম।
আমি তড়িঘড়ি আমার নিকটতম আত্মীয়দের সহযোগিতায় গোপনে নৌকাযোগে অন্যত্র সরে যাই। আমাদের নৌকা যখন মাত্র মাইল খানেক পথ অতিক্রম করেছে ঠিক সে সময় আমার সশস্ত্র প্রতিপক্ষরা আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে।
পরবর্তীতে, যারা আমাকে স্থানান্তরে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল, যদিও তাদের প্রাণে মারা হয়নি। নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয় মওলান আবদুল মোমেন ভাই, ভাগ্নে জামালউদ্দিন ও আর একজন প্রতিবেশী।
এরপরে আমার সব ধরণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য পুরোপুরি নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলি। অষ্টগ্রামের সাবিয়ানগর থেকে কুলিয়ার চর হয়ে কিশোরগঞ্জে এসে সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারপর আমাদের সমমনা বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে আমি আলবদর বাহিনী গঠন করলাম। ইতোমধ্যে রাজাকারদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে জুলুম হয়েছে এমন অভিযোগও আসছিল। আলবদর গঠন করে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সবরকমের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলাম জনগণের মধ্যে ভীতি ও সন্ত্রাসের ব্যাপ্তি ঘটেছিল, সেটাও অল্প কয়দিনেই কেটে গেল। জনগণের আস্থা ফিরে এলে আমরা গণ সমর্থন পেতে থাকলাম। কিন্তু এসব হল অনেক পরে এসে। শুরু থেকে এ সুযোগ না আসাটা জাতির জন্য ছিল চরম দুর্ভাগ্য।