বাংলাদেশে ভারতের সেনাপ্রধান -
আহমদ আশিকুল হামিদ
আগামীকাল বাংলাদেশে পদধূলি দিতে আসছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিনয় কুমার সেন, সংক্ষেপে ভিকে সিং। বিস্তারিত সফরসূচি সম্পর্কে জানানো থেকে সুকৌশলে বিরত থাকলেও আমাদের আইএসপিআর ভারতীয় জেনারেলের বাংলাদেশ সফরের প্রধান একটি উদ্দেশ্য আড়াল করেনি। জানিয়েছে, আগামী ২১ জুন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির নতুন কমিশনপ্রাপ্ত সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসারদের কুচকাওয়াজ ও সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে ভারতের সেনাপ্রধান স্যালুট গ্রহণ করবেন। অফিসারদের হাতে সনদও তিনিই তুলে দেবেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নতুন অফিসাররা তাকে সামনে রেখেই দেশকে রক্ষার শপথ নেবেন। বেছে বেছে জেনারেল ভিকে সিংকে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, এই জেনারেল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শেষ ভারতীয় অফিসার, যিনি এখনো চাকরিতে রয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্যেই তাকে বিএমএ'র কুচকাওয়াজে স্যালুট নেয়ার বিরল সম্মান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। প্রধান কারণ হলো, বিএমএ'র এই অনুষ্ঠানে সাধারণত বাংলাদেশ সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর প্রধানরা স্যালুট নিয়ে থাকেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো বিদেশীকে স্যালুট গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। কোনো দেশের সেনাপ্রধানের প্রশ্নই ওঠে না, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানও এই সম্মান পাননি। এর কারণ, অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা হয় এবং কমিশনপ্রাপ্ত অফিসাররা আল্লাহর নামে শত্রুর হামলা থেকে দেশকে রক্ষা করার শপথ পাঠ করেন। ক্যাডেট থাকার দিনগুলোতেও তাদেরকে পবিত্র কুরআনের আলোকে শিক্ষা দেয়া হয়। এজন্যই খুবই সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় এ অনুষ্ঠানে কোনো বিদেশীকে, বিশেষ করে অমুসলিম কাউকে প্রধান অতিথি হিসেবে স্যালুট গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় না। উল্লেখ্য, বিএমএ'তে বছরে দুটি সমাপনী অনুষ্ঠান হয়। একটি জুনে, অন্যটি ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী স্যালুট নিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে এবারই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটতে যাচ্ছে। জুনের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কোনো বাহিনী প্রধানের পরিবর্তে স্যালুট নেয়ার জন্য উড়ে আসছেন ভারতের সেনাপ্রধান।
আপত্তি ও প্রতিবাদের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, প্রতিবেশী হলেও বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব কখনোই বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারেনি। স্থল ও নৌ সীমান্ত এবং ছিটমহল নিয়ে ভারত এখনো সমস্যা জিইয়ে রেখেছে। ফারাক্কাসহ বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে ভারত রীতিমতো পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান বিপুল ঘাটতিতে রাখার মাধ্যমেও ভারত বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ-এর গুলীতে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু ঘটছে নিরীহ বাংলাদেশীদের। অর্থাৎ দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের কোনো একটি ক্ষেত্রেই দু' দেশের মধ্যে স্বাভাবিকতা ও সুস্থতা নেই। ভারতের মনোভাব ও কার্যক্রম বরং অবন্ধুসুলভ প্রমাণিত হয়ে আসছে, যাকে আসলে পরোক্ষভাবে শত্রুতাপূর্ণ বলাটাই সমীচীন। প্রচলিত নিয়মে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মূল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ভারতের নাম তাই বন্ধুরাষ্ট্রের তালিকায় থাকারই কথা নয়। প্রশিক্ষণকালে সশস্ত্র বাহিনীর সামনে যে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলোকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে রাখা হয় ভারতের নাম প্রকৃতপক্ষে সে তালিকাতেই থাকতে পারে। এটাই দেশে দেশে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ম। যেমন ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করা হয়। একইভাবে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সামনে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে রাখা হয় ভারতকে। চীনও রাশিয়ার পাশাপাশি ভারতকে সামনে রেখেই তার সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এমন এক ভারতের সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে, যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্তত বন্ধুত্বপূর্ণ বলার উপায় নেই।
আপত্তি ও প্রতিবাদের তৃতীয় কারণটি এসেছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো সমরাস্ত্র পেতে পারেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধের পরপর ভারতের সেনারা পাকিস্তানীদের সমুদয় সমরাস্ত্র লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর হিসাবে এসব সমরাস্ত্রের দাম ছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কোনো অস্ত্রই ছিল না। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল গণচীন। বস্তুত গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। এ সময়েও ৪৪টি অত্যাধুনিক ট্যাংক এবং এক স্কোয়াড্রনের বেশি জঙ্গি বিমানসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাইপলাইনে রয়েছে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
এমন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, বিএমএ'র কোনো অনুষ্ঠানে বিদেশী বলতে একমাত্র গণচীনেরই আমন্ত্রণ পাওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অসন্তোষের ভয়ে কিংবা ভারতকে খুশি করার উদ্দেশ্যে চীনের কথা চিন্তা পর্যন্ত করেনি। উল্টো চীনের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ভারতের সেনাপ্রধানকে নেমন্তন্ন করে ডকে এনেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকারের এই ভারতপ্রীতিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। চীন-ভারতের দ্বনদ্বমূলক দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। চীন ভাবতেই পারে, এত যেখানে ঘনিষ্ঠতা সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ভারত চীনের সামরিক প্রযুক্তি চালান করে নিয়ে যাবে- যা চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলেই বিষয়টিকে হালকা বা বিচ্ছিন্নভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এমন মাখামাখির আয়োজন করে গেছেন কেয়ারটেকার সরকারের নামে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। ক্ষমতা দখল থেকে ডিজিটাল নির্বাচন এবং ভিকে সিং-এর স্যালুট নেয়া পর্যন্ত সবই ঘটে চলেছে বহুল আলোচিত ‘রোডম্যাপ' অনুযায়ী। প্রসঙ্গক্রমে কুখ্যাত জেনারেল মইন উ'র ভারত সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির সে সফরের সময় তিন বাহিনী প্রধান তো বটেই, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীও মইন উ'র সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ছোট কোনো দেশের সেনাপ্রধানকে বড় কোনো দেশ সাধারণত এতটা ‘সম্মান' দেখায় না। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ কারণে মইন উ'কে তেমন ‘সম্মান'ই দেখানো হয়েছিল। মইন উ সেবার ভারত থেকে ছয়টি ঘোড়া ‘উপহার' হিসেবে এনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন- যদিও পরে জানা গেছে, এই ‘উপহার' যোগাড় করার জন্য গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশকে নগদে ছয় কোটি টাকা গুণতে হয়েছিল। বিষয়টিকে তখন মইন উ'র ‘অশ্ব কূটনীতি' আখ্যা দেয়া হয়েছিল। এতদিনে প্রমাণিত হয়েছে, কথাটা নিতান্ত কথার কথা ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মইন উ'র সে ‘অশ্ব কূটনীতি'রই দায় টানতে হচ্ছে।
এখানে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল মুবিনের ভারত সফরের কথাও উল্লেখ করা দরকার। ২০১০ সালের মার্চের এই সফরকালে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা ছিল একটি ‘শীর্ষ বৈঠক'। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতরে ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ‘শীর্ষ বৈঠক'টিতে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভিকে সিং এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল দীপক কাপুর। ভিকে সিং-এর নাম ততদিনে পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষিত হওয়ায় বৈঠকটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিল। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এর মাত্র দু'দিন আগে জেনারেল মুবিনের সঙ্গে দিল্লীতে বৈঠক করা সত্ত্বেও কলকাতায় উড়ে এসেছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল কাপুর। ফোর্ট উইলিয়ামের ‘বিশ্বস্ত সূত্রের' উদ্ধৃতি দিয়ে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া' ২২ মার্চ সংখ্যায় জানিয়েছিল, জেনারেল মুবিনের ভারত সফর দু' দেশের সেনাবাহিনীর যৌথ মহড়ার পথ খুলে দিতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে দু' দেশের সম্পর্কের যে উন্নতি শুরু হয়েছে তার ভিত্তিতে ভারত সামরিক সম্পর্কেরও উন্নতি ঘটাতে চাচ্ছে। ভারতের ইচ্ছা, বাংলাদেশ চীনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসুক এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনী চীনের সেনাবাহিনীর পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশ নিক। এ উদ্দেশ্যে মিজোরাম রাজ্যের ভাইরাংটেতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জঙ্গলযুদ্ধের প্রশিক্ষণ স্কুলে যৌথ মহড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের দুই জেনারেল। তাছাড়া কাউন্টার ইনসারজেন্সিতেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিল ভারত। ‘বিশেষ সূত্রের' উদ্ধৃতি দিয়ে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া' আরো জানিয়েছিল, চীনের পরিবর্তে ভারত বাংলাদেশে সমরাস্ত্রও সরবরাহ করতে চায়।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ভারতীয় জেনারেলদের প্রস্তাবের জবাবে ঠিক কি বলে এসেছিলেন সে ব্যাপারে ধারণা পাওয়ার জন্য প্রকাশিত রিপোর্টের অন্য একটি তথ্য প্রাধান্যে এসেছিল। এতে বলা হয়েছিল, জেনারেল মুবিনের ভারত সফর দু' দেশের সেনাবাহিনীর ‘যৌথ মহড়ার পথ খুলে দিতে চলেছে'। কথাটার ভিত্তিতে ধরে নেয়া যায়, ফোর্ট উইলিয়ামের শীর্ষ বৈঠকে জেনারেল মুবিন হ্যাঁসূচক জবাবই দিয়ে এসেছিলেন। এর প্রমাণও পাওয়া গেছে সফরের আগে-পরে। যেমন ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে বাংলাদেশ ও ভারতের সেনা কমান্ডোরা যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। মহড়ার সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন। এরও ক'দিন আগে, ১৯ জুলাই আগরতলার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে নরশিংগড় সীমান্তে বিডিআর ও বিএসএফ একই লাইনে যৌথ টহল দিয়েছিল। টহলের ছবিসহ খবরটি প্রচার করেছিল ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি। তারও আগে, ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত আসামের জোড়হাটে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এ সময়ই ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল।
এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতপন্থী নীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল এবং এর ভিত্তিতেই ফোর্ট উইলিয়ামের ‘শীর্ষ বৈঠকে' জেনারেল মুবিনের কাছে যৌথ টহলের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এটা বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক কোনো প্রস্তাব ছিল না। যৌথ মহড়ার মতো আয়োজনগুলো জেনারেল মইন উ'ই সম্পন্ন করে রেখে গেছেন। বর্তমান সেনাপ্রধান তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন মাত্র। বিষয়টি মোটেও সহজ-সরল নয়। মইন উ'র কুখ্যাত ‘অশ্ব কূটনীতি'র দায়, ডিজিটাল নির্বাচন এবং ‘রোডম্যাপের' শর্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের জন্য বাংলাদেশের ‘জানালা' খুলে দিতে হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তাই শুধু হুমকির মুখে এসে পড়েনি, একই সঙ্গে জানালার পর এসেছে বাংলাদেশের ‘দরোজা' খুলে দেয়ারও প্রস্তাব। এই ‘দরোজা' খুলে দিতে হবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য। সে উদ্দেশ্য থেকেই একদিকে যৌথ মহড়ার প্রস্তাব এসেছে, অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্যালুট গ্রহণের দুর্লভ সম্মান পেয়েছেন জেনারেল ভিপি সিং। এই আয়োজনের পথ ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনী যদি কখনো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, কলকাতায় যেদিন সেনাপ্রধানদের অঘোষিত শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠিক সেদিন, ১৯ মার্চই ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব জিকে পিল্লাই দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্দো-বাংলাদেশ সিকিউরিটি ডায়ালগ'-এ ঘোষণা করেছিলেন, শেখ হাসিনার নয়াদিল্লী সফরের মধ্য দিয়ে যে ‘সুফল' পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। এই সুফল ‘অর্জন' করতে হবে। কারণ, সুযোগের ‘জানালা' সব সময় ‘খোলা' থাকে না। সুতরাং ‘সুফল' অর্জনের ব্যাপারে সময় নষ্ট করা বা সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
প্রসঙ্গক্রমে ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর কিছু কথাও স্মরণ করা দরকার। পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের পর পর, ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ ভারতের পত্রিকা ‘এশিয়ান এজ'কে দেয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল রায় চৌধুরী বলেছিলেন, বাংলাদেশ খুব সহজে এবং বারবার নয়াদিল্লীর ‘রাডার' থেকে সরে যায়। কিন্তু এবার- অর্থাৎ পিলখানা হত্যাকান্ডের পর, তা আর হতে দেয়া যাবে না। সাবেক এই জেনারেলের বিশ্বাস, নয়াদিল্লীও নিশ্চয়ই চায় না, বাংলাদেশ আবারও তার ‘রাডার' থেকে সরে যাক। ভারত সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে জেনারেল রায় চৌধুরী বলেছিলেন, বাংলাদেশ যাতে আবারও নয়াদিল্লীর ‘রাডার' থেকে সরে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। এক্ষেত্রে গণচীন যে একটি প্রধান ‘ফ্যাক্টর' সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারতের এই সাবেক সেনাপ্রধান ভারতকে খুবই সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার ‘কার্ড' খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সে ‘কার্ড' খেলার অংশ হিসেবেই ফোর্ট উইলিয়ামে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জেনারেল ভিপি সিংও স্যালুট নিতে এসেছেন একই ‘কার্ড' খেলার অংশ হিসেবেই। আর সবই সম্ভব হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতপন্থী নীতি ও উদ্দেশ্যের কারণে। বাস্তবে সকল দিক থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতের অধীনস্থ করার পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করে চলেছে শেখ হাসিনার সরকার।