দুই বাংলা কেন এক হলো না
28 Feb, 2015
মেহেদী হাসান পলাশ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তিনদিনের ঢাকা সফর নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে এমন ব্যাপক প্রচার লক্ষ্য করা গেছে যে, মনে হয়েছে, মমতার এই সফরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সকল জট খুলে যাবে। অবশ্য শুধু গণমাধ্যম নয়, সরকারের তরফ থেকেও একজন সরকারপ্রধানের মতো মর্যাদা ও প্রটোকল নিশ্চিত করা হয় তার জন্য। তবু বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও দাবির ব্যাপারে শুকনো মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দেননি মমতা। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, জঙ্গী, জামায়াত সম্পর্কের ইস্যুতে বিপাকে পড়া মমতা অস্বস্তি কাটাতেই বাংলাদেশ সফর করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ভোজ সভায় ৫ পদের ইলিশ ব্যাঞ্জন দেখে মমতা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে টিপ্পনী কেটে নাকি বলেন, এখানে ইলিশ পাচ্ছি অনেক, কিন্তু কোলকাতায় তো ইলিশ যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীও তার সপ্রতিভ উত্তরে বলেন, তিস্তায় পানি আসছে না। পানি না এলে ইলিশ তো উড়ে যেতে পারে না। পানি এলে ইলিশ যাবে। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের জবাবও দিয়েছেন মমতা, ইলিশ তো পদ্মার মাছ। তিস্তার পানিতে ইলিশ থাকে এমন কথা তো শুনিনি।
মমতার এই সফরে সঙ্গীর তালিকায় বিনোদন জগতের লোকদের আধিক্য ছিল। এর মাধ্যমে বোঝা গিয়েছিল, অস্বস্তি কাটানোর পাশাপাশি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাজার দখলও মমতার কূটনীতির অংশ ছিল। এফডিসিতে টালিউডি অভিনেতা ও কলাকুশলীদের বৈঠকে সে বিষয়টি তারা প্রকাশ্যেই বলেছেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে কার্যকর কোনো আলোচনা করেননি তারা। মমতার এই সফরকালে রাজধানীর একটি হোটেলে দুই দেশের সাংস্কৃতিক জগতের লোকদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস। এ অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয় ‘বৈঠকী বাংলা’। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইবার জন্য অনুরোধ করা হয় কোলকাতার শিল্পী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়, ইন্দ্রনীল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত মাঝের অন্তরা থেকে গাইতে শুরু করেন। ফলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশী শিল্পীরা এর প্রতিবাদ শুরু করলে মমতা তাকে থামতে বলে প্রতিবাদের কারণ জানতে চান।
বিষয়টি অবগত হওয়ার পর মমতা নিজেই স্টেজে উঠে দুই বাংলার খ্যাতনামা শিল্পীদের মঞ্চে ডাকেন এবং সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে কোলকাতার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘আমার একটা ছোট্ট কথা বলার ছিল। ৬৭-৬৮ বছর আগে এপার বাংলা, ওপার বাংলা হয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক কা- ঘটে গেছে। এখন থেকে এপার বাংলা, ওপার বাংলা না বললেই বোধ হয় ভালো।’ অনুষ্ঠানে টালিউডের হালের সুপারহিট নায়ক দেব আরো এককাঠি এগিয়ে বলেন, ‘আমাদের ভাষাটা (বাংলা) পৃথিবীতে পঞ্চম স্থানে। আমি জানি, আমরা কেউ এটা আমাদের জন্য করছি না। আমাদের জীবনটা খুব ভালো কেটেছে বা কেটেও যাবে। কিন্তু সমাজে আমরা যে স্থানটাতে আছি, এটা আমাদের দায়িত্ব, এই ভাষাটাকে নিয়ে আমাদের কিছু বলা উচিত। সেই কারণে হয়তো আমরা এখানে এসেছি। আমাদের স্বপ্ন এক, আমাদের ইচ্ছেটাও। সবকিছুই যখন এক, তাহলে আমরা দুই সরকারকে বলি যে প্লিজ, এপার বাংলা, ওপার বাংলাকে এক বাংলা করে দাও।’
শুধু দেব নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই কোলকাতার বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা বাংলাদেশে এসেই ‘আমি বাংলার গান গাই’ বলে গদগদ চিত্তে বলে থাকেন, এই কাঁটাতার, সীমান্ত তুলে দাও, দুই বাংলা এক করো, ইত্যাদি। কিন্তু দুই বাংলাকে কীভাবে এক করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা ব্যাখ্য কেউই দেন না। দুই বাংলা এক বলতে যদি বাংলাদেশ সীমান্ত মুছে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিশে যাওয়া বোঝায় তাতে দুই বাংলা কখনো এক হয় না বরং বাংলাদেশ এক মহাভারতের সাগরতীরে লীন হয়ে যায়। কিন্তু যদি সত্যিকার অর্থেই অখ- সার্বভৌম বাংলা যা শরৎবসু, সোহরাওয়ার্দীসহ মুসলিম লীগের নেতারা চেয়েছিলেন তা বোঝায়, তাহলে আজ পশ্চিমবঙ্গকে প্রথমে ভারত থেকে আলাদা বা স্বাধীন হতে হবে। তারপর আসবে এক হওয়ার কথা। দেবরা কি সেই বাংলার কথা বলছেন? সেই বাংলা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষই চেয়ে এসেছে সেই চল্লিশের দশক থেকে। তবে সেই বাংলা বাস্তবায়নের আগে আজকের নায়ক দেবকে জানতে হবে বাংলা কেন ভাগ হয়েছিল।
ইতিহাসে বাংলা বহুবার ভাগ হয়েছে। তবে অখ- বাংলার যে রূপটি চল্লিশের দশকে শরৎবসু, সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার প্রকৃত রূপটি ইতিহাসে প্রথম পরিদৃষ্ট হয় সুবা বাংলা হিসেবে।
সিরাজ-উদ-দৌলার কাছ থেকে ক্ষমতা নেয়ার দেড়শ’ বছর পর ইংরেজরা প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু এর তীব্র বিরোধিতা করেন কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের হিন্দু বুদ্ধিজীবী, জমিদার ও সুবিধাভোগী সম্প্রদায়। ড. আম্বেদকরের ভাষায়, ‘বাঙালি হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করার প্রধান কারণ ছিল, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে’। (ড. আম্বেদকর : পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া পৃষ্ঠা-১১০)। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গে জমিদার ও পেশাজীবীরা তাদের জমিদারী, ক্লায়েন্ট ও বাজার রক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ফলে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে উঠে পড়ে লাগে। গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন। কিন্তু মুসলমানরা সেই আন্দোলনে শরীক হয়নি। কারণ “বাংলার হিন্দু সমাজ প্রচার করতে থাকে যে, বঙ্গভঙ্গ অর্থ হচ্ছে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ এবং ফলে দেবী কালীর প্রতি অপমান। হিন্দু ধর্মে কালী মাতৃভূমির প্রতীক। তাই বঙ্গভঙ্গবিরোধীরা ‘বন্দেমাতরমকে’ তাদের জাতীয় সেøাগান ও জাতীয় সঙ্গীতে রূপ দেয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস থেকে এ সঙ্গীত নেয়া হয়েছে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে ১৭৭০-এর দশকের বাংলার মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে। স্বভাবতই ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটি মুসলিমবিরোধী। মিছিলে ও সভা-সমিতিতে এ সঙ্গীতের ব্যাপক ব্যবহার মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানে এবং পরিণতিতে বাংলার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূচনা করে। (আইএইচ কোরেশী : দি কজ অভ দ্য ওয়ার অভ ইন্ডিপেনডেন্স, পৃ-১৭০; আরো দেখুন, ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন, মুহম্মদ ইনাম উল হক, পৃ-১৩৯)। এসময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক সরল চট্টোপাধ্যায় ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থে লিখেছেন :
“বাংলাবিভাগ পরিকল্পনা প্রকাশিত হবার পর অসংখ্য সভা-সমিতি সারা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৩-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯০৩-জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫০০ সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। ১৯০৫ পর্যন্ত ছোট-বড় এবং অতিবিশাল প্রায় ২ হাজার বঙ্গভঙ্গবিরোধী সভায় নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। ১৯০৫-এর অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে বলে সরকার ঘোষণা করে। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে এই দিন ‘রাখী বন্ধন দিবস’ রূপে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবছর ১৬ অক্টোবর ‘রাখী বন্ধন উৎসব’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই দিন শোভাযাত্রা শুরু হয় এবং পথের দু’ধারে সবার হাতে রাখী পরিয়ে দেয়া হয়। রাখী বন্ধন উৎসব বাংলাবিভাগবিরোধী রাজনৈতিক উৎসবে পরিণত হয়।” শুধু তাই নয়, এই উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার বিখ্যাত গান-
‘বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল...
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালী ঘরে যতো ভাইবোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান’।
রবীন্দ্রনাথ এসময় দেশমাতাকে ‘কালীমাতার’ মধ্যে মিলিয়ে রচনা করেন অসংখ্য সঙ্গীত যা বঙ্গভঙ্গবিরোধীদের আন্দোলনে প্রেরণা যোগায়। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে কোলকাতার হিন্দু সম্প্রদায় গড়ে তোলে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। এ সংগঠনের নেতৃত্বে সারাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় অসংখ্য ভবানী মন্দির। ভবানী মন্দিরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা দেবী ভবানী বা কালীর সামনে উপবেশন করে মাথায় গীতা ও তরবারী রেখে বুকচিরে রক্ত দেবী কালীর পায়ে নৈবেদ্য দিয়ে মন্ত্র জপের মাধ্যমে শপথ নিয়ে সদস্য হতেন। এরকমই একজন কর্মী ছিলেন ক্ষুদিরাম। ‘১৯০৩ সালে কিশোর ক্ষুদিরাম শপথ নিয়ে দীক্ষা গ্রহণ করলেন মেদেনীপুরে সত্যেনবসুরই নির্দেশনায়। ১৪ বছরের বালক ক্ষুদিরাম কি জানি কোন দুঃখে কিম্বা মনের আবেগে বা দুর্বার আকর্ষণে দিক্ষীত হলেন গুপ্ত সমিতিতে। (মুহাম্মদ সানাউল্লাাহ আখুঞ্জী : ক্ষুদ দিয়ে কেনা ক্ষুদিরাম, উপমা ডাইজেস্ট, ডিসেম্বর ১৯৯১)। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে তার পরিবর্তে ব্যারিস্টার মি. কেনেডির স্ত্রী মিসেস কেনেডি ও তার কন্যার উপর বোমা হামলা করে হত্যা করেন। পরের দিন তিনি ধরা পড়েন। ১১ আগস্ট মুজাফ্ফরপুর জেলে তার ফাঁসি হয়। এরপর ক্ষুদিরামকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্নিসেনানী রূপে চিত্রিত করতে লেখা হয় অসংখ্য গান ও কবিতা। সেসব গানেরই একটির দু’ লাইন এমন-
‘বড় লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম ইংল্যান্ডবাসী’। ক্ষুদিরাম টার্গেট করেছিলেন কোলকাতার সামান্য ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে। কোথায় বড়লাট লর্ড কার্জন আর কোথায় সামান্য ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড!
কোলকাতার হিন্দুদের এই মুসলিমবিরোধী অবস্থানের কারণে বাঙালি মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা রাজনৈতিক ফোরামের কথা চিন্তা করে। বিমলানন্দ শাসমলের মতে, ‘বাংলা ও ভারতের প্রবল হিন্দু জনমতের কাছে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ পরিত্যক্ত হওয়ায় মুসলমানদের মনে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলে মুসলিম লীগের জন্ম হয়’। (স্বাধীনতার ফাঁকি, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা-৬৫)। অবশেষে সন্ত্রাসী আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। কোলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন অখ- স্বাধীন ভারতের সম্ভাবনাও নস্যাৎ করে ভারতবর্ষের বুকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টির বীজ বপন করেছিল। অথচ যারা ১৯০৫ সালে অখ- বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল সত্যিকার অখ- বাংলার সম্ভাবনা যখন সৃষ্টি হলো ১৯৪৭ সালে, তখন তারা এর প্রবল বিরোধিতা করে বসলো।
বিমলানন্দ শাসমলের ভাষায়, ‘১৯৪৭ সালে মুসলমানরাই চাইল অবিভক্ত বাংলা আর হিন্দুরা চাইলো বাংলা বিভাগ। ১৯০৫ সালে কার্জন যা চেয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে হিন্দুরা স্বেচ্ছায় সে প্রস্তাবকে কার্যকরী করলো।’ (ভারত কী করে ভাগ হলো, বিমলানন্দ শাসমল, ভূমিকা দ্রষ্টব্য)। “অখন্ড বাংলার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে নিখিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভার পূর্ব নির্ধারিত বিশেষ অধিবেশন বসলো ১৯৪৭ সালের ২০ জুন। পূর্ব ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার সদস্যগণ আলাদাভাবে অধিবেশনে মিলিত হলেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার সদস্যদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের স্পিকার নুরুল আমিন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ১৯৬ জন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দিয়ে অখ- সার্বভৌম বাংলার পক্ষে তাদের সমর্থন প্রকাশ করলেন। পক্ষান্তরে কংগ্রেস দলীয় ৩৪ জন সদস্য বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দিয়ে অখ- স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। আর তফসিলী ফেডারেশনের ৫ জন সদস্য বাংলাকে ভাগ করার বিপক্ষে ভোট দিয়ে অখন্ড বাংলাকে সমর্থন করলেন। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর চিত্র ছিল ভিন্ন। কংগ্রেস এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা ও জ্যোতিবসুর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির মোট ৫৮ জন সদস্য বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দিলেন। বাংলা ভাগের বিপক্ষে অর্থাৎ অখ- স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ভোট দিলেন ২১ জন সদস্য।” (বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা-২৮৮)
শরৎবসু, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিমসহ বাংলার হিন্দু-মুসলিম নেতাদের প্রবল দাবির মুখে যখন অখ- স্বাধীন বাংলার দাবি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল তখনই কোলকাতার বুকে সংগঠিত হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। ‘হিন্দু পক্ষে এটা ছিল বাংলা ভাগের জন্য লড়াইয়ের একটা অংশ বিশেষ। এর সংগঠকদের মধ্যে ছিল মহাসভা ও কংগ্রেসের সদস্য বিশেষ করে পুরোনো সন্ত্রাসী কংগ্রেস নেতা যারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়নি’। (বেঙ্গল ডিভাইড, জয়া চ্যাটার্জি, অনুবাদ আবু জাফর, পৃষ্ঠা-২৭১)। সেই সময়কার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মুসলমানরা মোটেই এ দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না, এ কথা আমি বলতে পারি।’ “ছাত্র পেশাজীবী ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ও পাড়ার ভাড়াটে গু-া মার্কা ছেলেদের অভাবিত ঐক্যের ফলে হিন্দু জনতার রক্তক্ষয়ী বিজয় হয় কোলকাতার রাস্তায়, ১৯৪৬ সালে। এটাই বাংলা বিভাগ এবং একটা পৃথক হিন্দু আবাসভূমি গঠনের জন্য হিন্দু আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছে। কিন্তু হিন্দুদের এই জঘন্য কাজকে কখনোই স্বীকার করা হয়নি। হিন্দু সংবাদপত্র এই আক্রমণের জন্য দোষারোপ করে সোহরাওয়ার্দী সরকার ও মুসলিম লীগকে; আর এই হত্যাযজ্ঞকে গণ্য করা হয় ভবিষ্যতে ‘মুসলমান শাসনের’ অধীন বাঙালি হিন্দুদের ভাগ্যর ভয়াবহ অশুভ লক্ষণ হিসাবে।” (বেঙ্গলডিভাইড, জয়া চ্যাটার্জি- পৃষ্ঠা-২৭৭)। তবু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখ- বাংলার দাবি ও চেষ্টা থেকে সরে আসেননি। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী দিল্লীতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, খন্ডিত পশ্চিম বাংলা পশ্চিম ভারতের কলোনি হবে। “২৩ এপ্রিল জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের মধ্যে পাঞ্জাব ও বাংলাভাগের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলো। মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করলেন যে, বাংলায় ভাগ বন্ধ হতে পারে... একটি শর্তে যে, বাংলা পাকিস্তান বা ভারতে যোগ দেবে না। সে কথার উত্তরে জিন্নাহ মাউন্ট ব্যাটেনকে বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলাকে স্বাগতম জানাবেন। কারণ কোলকাতা না পেলে বাংলাদেশের বাকি অংশ নিয়ে কী লাভ হবে?... ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সহযোগিতায় বাংলাভাগের যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তা প্রতিহত করার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ণ দায়িত্ব দেন।’ (পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি : কামরুুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা-৮৯)।
ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি পাকিস্তান নিয়ে তার গভীর আবেগের কথা ব্যক্ত করেছেন। ‘পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কী করবো? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা-৩২)। তিনি আরো লিখেছেন, ‘অখ- ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।’ (পৃষ্ঠা-৩৬)।
পাকিস্তানের প্রতি গভীর আবেগ সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান অখ- বাংলার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করেছেন এভাবে, “এই সময় শহীদ সাহেব, হাসিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎবসু ও কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায় কিনা? শহীদ সাহেব দিল্লীতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তারা অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এ ফর্মুলা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসু দিল্লীতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎবসু নিজে লিখে গেছেন যে, জিন্নাহ তাকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎবাবু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটল তাকে বলেছিলেন, ‘শরৎবাবু পাগলামী ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই। মাহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কিছুই না বলে তাকে সরদার প্যাটলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটল তাকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎবসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথাও স্বীকার করেছিলেন’।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-৭৪)। এরপর ‘শরৎবসুকে ১৯৪৭ সালের ৮ জুন লিখিত এক চিঠিতে গান্ধী জানিয়ে দেন যে, তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে নেহেরু ও প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেছেন এবং এই উদ্যোগের প্রতি তাদের সম্মতি নেই। গান্ধী তার এই চিঠিতে শরৎবসুকে অখন্ড স্বাধীন বাংলার গঠনের পরিকল্পনা ত্যাগ করার জন্য বাংলা ভাগের বিরোধিতা হতে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেন।’ (বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা-২৮২-২৮৩)।
দেব বাবুরা নিশ্চয় উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারছেন, খন্ডিত বাংলা কাদের ভুলের ফসল? তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ও এদেশ থেকে যাওয়া অনেক শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা কোলকাতায় অখন্ড বাংলার আলোচনা করেছেন। কিন্তু পশ্চিম বাংলা থেকে কোনো সাড়া আসেনি। একটি বৃহৎ বা অখন্ড বাংলার স্বপ্ন বাংলাদেশের। মমতার সফরসঙ্গী দেব তার আবেগ থেকে অখন্ড বাংলার কথা বলেছেন। এর জবাবে বাংলাদেশের খ্যাতিমান নাট্য নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী তার ভেরিফাইড ফেসবুক প্রোফাইলে দেবকে অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘দুই বার্লিন এক হতে পারলে দুই বাংলা নয় কেনো? আশা করছি কোলকাতা ফিরে তারা বাংলাদেশের সাথে যোগ দেয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করবে। আমরা আপনাদের পাশে থাকবো। ঐ দিকে মমতা ব্যানার্জির সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ উৎসাহ দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশে এসে আমাদের পিঠ চাপড়ে, বাংলা আমার মা জাতীয় কথা বলাকে যারা সন্দেহের চোখে দেখছেন তাদেরকে ভুল প্রমাণ করার জন্য কোলকাতা ফিরে উদ্যোগ নেয়ার জন্য মমতা আপাকে আহ্বান জানাই। আশা করি, বাংলাদেশের প্রতি এই প্রেম কোলকাতায় ফিরেও অব্যাহত রাখবেন।’