Amardesh Online Edition
ফেলানি : পৈশাচিকতার শিকার
বিউটি আক্তার হাসু
কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির নিথর দেহ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ এ কবিতাটি নতুন করে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়।
‘মুণ্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভত্স শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভিতরে
আমি ঘুমোতে পারি না, আমি ঘুমোতে পারি না।’
ফেলানির ঝুলন্ত লাশ, ঘুরে ফিরছে তার আসা বাংলার চারপাশ। তন্দ্রার ভেতরেও যেন ফেলানি আর্তনাদ করে তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানায়। ফেলানির কান্নার ধ্বনি, বাতাসে মিশে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে আর বলছে, ‘ওদের আমার মতো করেই বুলেটের আঘাতে বক্ষ ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়া হোক।’ চোখ বন্ধ করলে ফেলানির ঝুলন্ত লাশ দেখে শিহরিত হই, শোকে বিহ্বল হই। চোখ খুলে পানির জন্য ফেলানির আর্তচিত্কার, ছটফটানি অনুভব করে তীব্রভাবে। তাই তো আনাড়ি হাতে বাধ্য হলাম দু’কলম লিখতে। কাঁটাতারে ফেলানির লাশ ৮ ঘণ্টা ঝুলে থেকে ‘ভারত-বাংলাদেশ মিত্র’কে ধিক্কার জানিয়ে গেছে। প্রশ্ন রেখে গেছে পুরো বাঙালি জাতির সামনে—মাঝখানে ‘ঝুলন্ত লাশ’ রেখে বন্ধুত্ব হয় কীভাবে?’
ফেলানিরা কি মাটির খেলনা? চাইলেই তাকে দুমড়ে-মুচড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়া যায়? চাইলেই বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়া যায়? কাঁটাতারে ৮ ঘণ্টা ফেলানির লাশ রেখে বন্ধুত্বের নামে যে নমুনা ভারত দেখাল সত্যিই তা নজিরবিহীন। বন্ধুত্বকে কলুষিত করার যে দৃষ্টান্ত ভারত স্থাপন করল তা নিঃসন্দেহে বিরল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাঁধন অধিকারীর লেখা ‘কাঁটাতারে ঝুলন্ত মানবাত্মা’ ঘুমন্ত বিবেক বোধকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়ার মতো। (১৭ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশ, পাঠকমেলা
ফেসবুকে বাঁধনের বন্ধুরা বলছেন, ‘কাঁটাতারে ঝুলছে বাংলাদেশ’। বাঁধন তার থেকে একটু সরে বলছেন, ‘বাংলাদেশ না, কাঁটাতারে ঝুলছে মানবাত্মা। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি মিডিয়া-মার্কেট-মিলিটারি যুগের বৈশিষ্ট্যকে বুকে ধারণ করে ভারত নামের রাষ্ট্রটির সঙ্গে যে স্বার্থগত বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, ঋণচুক্তি-ট্রানজিট-টিপাইমুখ-পানি নিয়ে ভারতীয় সাম্রাজ্যের যে আগ্রাসন, সবকিছুকে ছাপিয়ে ওই মানবাত্মার কান্নার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি আমি। ওই মানবাত্মা আমার; সে ভারত বোঝে না, সে বিএসএফ বোঝে না, পরিবর্তিত নামে আবির্ভূত হওয়া বর্ডার গার্ড বোঝে না।’
বাঁধন আরও লিখেছেন, ‘কেন পানি পানি বলে চিত্কার করেছিল ফেলানি? পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি, পারিনি আমরা দুর্বল রাষ্ট্র বলে, সে কি ফেলানি জানত না?’
আসলে কি ফেলানি জানত? হয়ত, জানত বলেই বার বার ‘পানি পানি’ করে চিত্কার করেছে/সবাইকে সে বলতে চেয়েছে—পানির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আজ আমি একা জীবন দিচ্ছি। এ থেকে বাঙালি জাতি তোমরা শিক্ষা নাও। এখনও সময় আছে। তা না হলে একদিন পানির জন্য চিত্কার করতে করতে তোমাদের গলাও শুকিয়ে যাবে। পানির জন্য তোমাদের বুকে চর পড়বে। বন্ধুদেশ তোমাদের জন্য কারবালা সৃষ্টির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ফেলানির ঝুলন্ত আত্মা হয়ত বিড়বিড় করে বলেছিল—এই দেশ, এই মাটি আমার। এই মাটির সুধা গায়ে মেখে আমি বেড়ে ওঠেছি। এটা আমার প্রিয় মাতৃভূমি। এদেশের মাটি স্পর্শ করে আমি মরতে চাই। আমার সোনার বাংলা? ওই ঘাতকরা আমার দেশের মাটিতে মাথা রেখে মরতেও দিল না। দেশবাসী তোমরা ওদের ক্ষমা করো না। ওদের বিচার করো। তা না হলে আমি তোমাদের কোনো দিন ক্ষমা করব না, কোনো দিন না। ফেলানি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে ধিক্কার দিয়েছে, দেশকে নয়। তাই তো মাটির টানে ছুটে আসছিল ১৫ বছরের কিশোরী বউ সাজার স্বপ্ন নিয়ে। দেশে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, তার সে স্বপ্নের কবর রচনা করেছে বন্ধুদেশের শত্রুরা।
ফেলানির লাশ! কবি হাসান হাফিজের লেখা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালির বন্ধু পিরিতির কথা।
কবি হাসান হাফিজের ভাষায়—‘ফেলানির বাবার দীর্ঘশ্বাস আছড়ে আছড়ে হারিয়ে যায় নিষ্ঠুর চরাচরে। বিএসএফের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করেছে বলে শুনিনি। ফেলানির জীবন কিছুতেই ফিরে পাওয়া যাবে না। অন্তত প্রতিবাদটুকু করা হলে আমরা সামান্য হলেও সান্ত্বনা পেতাম।’
কবি আরও লিখেছেন—‘মার খেতে খেতে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাব। তারপরও বলতে হবে, হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আপনারা কত্ত ভালো। আমরা ধন্য হয়ে গেলুম। বাংলাদেশের বুকচিরে ট্রানজিটের আবদার করবেন, ব্যবসা-বাণিজ্যও লুটেপুটে নেবেন। আবার ইচ্ছেমত মারপিটও করবেন।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘যতদিন না পারস্পরিক সম্পর্ক প্রকৃত শ্রদ্ধাবোধের ভিতের ওপর দাঁড়াচ্ছে, ততদিন মৈত্রী ও বন্ধুত্ব কেবল কাগুজেই থাকবে। মাঝখানে থাকবে ফেলানিদের রক্তের ধারা।’
কবি হাসান হাফিজের লেখা থেকে আমরা এ সত্যই অনুধাবন করতে পারি। রক্তের স্রোতে দাঁড়িয়ে আর যাই হোক, বন্ধুত্ব হয় না। কোনো ভালো সম্পর্ক এক পক্ষ থেকে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। উভয় পক্ষেরই আন্তরিক হতে হয়।
একতরফা বন্ধুত্ব হয় না। একথা কবি হাসান হাফিজ, ড. তারেক শামসুর রেহমান, বাঁধন অর্থাত্ আমরা যেমন বুঝতে পারছি, তেমনি এ নির্মম সত্যটুকু রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মেনে নেয়া উচিত। ফেলানির লাশ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালির অসহায়ত্বের কথা।
ড. তারেক শামসুর রেহমান—‘যে মৃত্যু বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’ শিরোনামে প্রকাশিত। এর কিছু অংশ তুলে ধরছি—‘ফেলানি এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এক কিশোরীর নাম। ঝুলে ছিল লাশ হয়ে, কাঁটাতারের বেড়ায়। ১৪ বছরের ফেলানির বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল পরদিন। কিন্তু বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি ভারত যাওয়া হলো না ফেলানির। লাশ হয়ে ঝুলে থাকল কয়েক ঘণ্টা। ৮ জানুয়ারিতে লাল পায়জামা পরা লাশ হয়ে ঝুলে থাকা ফেলানির ছবি দৈনিক নয়া দিগন্তে যারা দেখেছেন, তাদের হৃদয় কতটুকু হাহাকার করে উঠেছিল, আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি কেঁদেছি। কেঁদেছি ফেলানির জন্য, আমার মেয়ের মতো যার বয়স। ফেলানি এক টুকরো বাংলাদেশ। বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল ফেলানি।’
আমি সমঝদার। তাই ড. তারেক শামসুর রেহমান—আপনার চোখের পানির আমি কদর করি। এই পানির জন্যই ফেলানির আর্তচিত্কার আধঘণ্টা বাতাসে ধ্বনিত হয়েছে এবং তা ফেলানির বাবার কানে আজও বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু কাঁটাতার ভেদ করে সে চিত্কার বিএসএফের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। এই ‘পানি’ নিয়েই জমে ওঠেছে বন্ধু বন্ধু খেলা। কিন্তু আমি কাঁদিনি। বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করে ওঠেছে। ফেলানির ঝুলন্ত লাশ ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী’কে ধিক্কার দিয়ে চিনিয়ে গেল কাঁটাতারে ঘেরা সীমানার ভয়াবহতার কথা।
ফেলানি কোনো লাশের নাম নয়। ফেলানি কোনো ফেলনা নাম নয়। ফেলানি মানে—বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা। ফেলানি মানে—একখণ্ড সবুজ ভূমি। ফেলানি বাংলাদেশের মানচিত্রের নাম। ফেলানি মানে—রক্তাক্ত জাতির পতাকা। ফেলানি মানে—একটি ছোট্ট দেশ, নাম বাংলাদেশ।
ফেলানির মৃতদেহ—যেন কবিতার ভাষা, লেখনীর খোরাক হয়েই না থাকে। এ হত্যার সুষ্ঠু বিচারের জোর দাবি রইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে, রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার কাছে। আর কোনো ফেলানির রক্তে যেন সীমান্ত রঞ্জিত না হয়, দেশের মাটি রক্তাক্ত না হয়।
ফেলানির ঝুলন্ত লাশ ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী’কে ধিক্কার দিয়ে চিনিয়ে গেল কাঁটাতারে ঘেরা সীমানার ভয়াবহতার কথা।
ফেলানি কোনো লাশের নাম নয়।
ফেলানি কোনো ফেলনা নাম নয়।
ফেলানি মানে—বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা। ফেলানি মানে—একখণ্ড সবুজ ভূমি।
ফেলানি বাংলাদেশের মানচিত্রের নাম।
ফেলানি মানে—রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
ফেলানি মানে—একটি ছোট্ট দেশ, নাম বাংলাদেশ।
তাই ফেলানির মৃতদেহ—যেন কবিতার ভাষা, লেখনীর খোরাক হয়েই না থাকে।