What's new

Bangladesh on January 5th and Afterwards

খালেদার জয়-পরাজয়
ফরহাদ মজহার
২২ জানুয়ারি ২০১৪, বুধবার, ৯:২৯

11339_Farhad-Mazhar1.gif

এক.
আগের লেখায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে আলোচনা করেছি (দেখুন, ‘হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরন’Ñ নয়া দিগন্ত, ১৯ জানুয়ারি ২০১৪)। সেই প্রসঙ্গে ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর তখনকার বর্জনের নেত্রী শেখ হাসিনার বিখ্যাত ‘নয় দফা’র কথাও সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছি। বেগম খালেদা জিয়া ১৫ জানুয়ারিতে যে কর্মসূচি ও বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে শেখ হাসিনার নয় দফা তুলনা করলে মনে হয় বিএনপি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অর্জন সম্পর্কে অস্পষ্ট। অন্য দিকে গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
বিএনপি আইন মেনে চলা ভোটাভুটির দল। উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেই তাকে থাকতে হবে। তাই এই উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎকণ্ঠাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিএনপি অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে যেভাবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা ঘটেছে, তার ইতিহাস মনে রাখেনি। অস্বীকার করবার উপায় নাই যে স্বাধীনতার পর অতীতের যেকোন আন্দোলনের চেয়ে এবারের আন্দোলন ছিল ব্যাপক ও জনগণের অংশগ্রহণও ছিল বিপুল। ঢাকা অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এর আগে একাত্তরের পর দেখা যায়নি। আন্দোলনের দিক থেকে এটা ছিল সুস্পষ্ট বিজয়; জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের এই শক্তিকে খালেদা জিয়া কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন, বলা মুশকিল। কারণ ২৯ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সরকারের মারমুখী সহিংসতার কারণে সফল করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের মাত্রা অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবার নজির অবিশ্বাস্য। আন্দোলনের বিস্তার ও বিপুল অংশগ্রহণের ফলে সহিংসতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান ছিল।
তবে জনগণের প্রতিরোধের রূপ বা ধরনের দিক থেকে, এবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা অতীতের গণ-আন্দোলনের ধরন কিম্বা মাত্রা অতিক্রম করেনি। এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কেউ গ্রেনেড বা স্বয়ংক্রিয় কোন অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়েছে, এমন কোন নজির বা অভিযোগের কথা জানা যায় নাই। গানপাউডার দিয়ে বাস ও বাসের আরোহীদের পুড়িয়ে মারা, মলটভ ককটেল (১৮ দল ছুড়লে যার নাম বদলে গিয়ে হয় ‘পেট্রল বোমা’) মেরে যানবাহন আগুনে ছাই করে দেয়া, রেলস্টেশন পুড়িয়ে ফেলা, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলাÑ ইত্যাদি সকল প্রকার ‘তাণ্ডব ও সন্ত্রাস’ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন, তার খালেদা জিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই পর্বে। এটাই এ দেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ বা ফর্ম হিসেবে আন্দোলনের ধরন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার বিরোধী দল বারবার অনেক ঘটনাকে সরকার পরেই করা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, এ েেত্র তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু ও নিরপে তদন্ত হয়নি। সরকারপীয় গণমাধ্যমগুলোর একপীয় মিথ্যাচারে সত্য আড়াল হয়ে গিয়েছে।
ুব্ধ হয়ে বাসে আগুন দেয়া এক জিনিস আর গানপাউডার সাথে বয়ে নিয়ে বাসে আগুন দেয়া চরিত্রের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধরন। এমনকি যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যানবাহনে অগ্নিসংযোগের েেত্র এই দুই ধরনের রূপ আরো ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনার দাবি রাখে। মানুষকে বাস থেকে বের হতে না দিয়ে গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগানো এবং পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষগুলোকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা ও ক্রমাগত জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-বিােভের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারের কাজে ব্যবহারের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। এর কোন জবাব এখনো মেলেনি। এভাবে পুড়িয়ে মারা ও বার্ন ইউনিটে তা প্রদর্শনের প্রপাগান্ডা কৌশল মতাসীনদের দমনমূলক রাজনীতিকেই মদদ জোগায়। অপকর্মটি বিরোধী রাজনীতির কাণ্ড কি না সন্দেহ সৃষ্টি করে। ফলে এর নিরপে ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া খুবই জরুরি।
সরকারি সশস্ত্রতার বিরুদ্ধে অনন্যোপায় হয়ে পাল্টা ভয় দেখানোর শব্দ তৈরি করা বা ঘরে বোমা তৈরি করে ভীতিকর ধোঁয়া সৃষ্টি করার ‘আরবান টেররাইজেশন’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে গণ-আন্দোলনের সীমার মধ্যকার তৎপরতা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। একেও অনেকে নিন্দা করতে পারেন, ঠিক আছে। কিন্তু এর কারণে গণবিােভের ন্যায্যতাকে নাকচ করে দেবার রাজনীতি সমর্থনের সুযোগ নাই। সেটা হয়ে দাঁড়ায় মতাসীনদের রাজনীতি ও তাদের প্রপাগান্ডার অস্ত্র। অথচ তারা নিজেরা এর চেয়েও অনেক বেশি সন্ত্রাস ও সহিংসতা করেই আজ মতায় বসে আছেন। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকাণ্ডের কথা না-ই বা তুললাম!
আন্দোলন-সংগ্রামে ুব্ধ ও সীমিত সহিংস চরিত্র থাকা, আর মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এক কথা নয়। গানপাউডার ব্যবহার আর সর্বোপরি যাত্রীদের নেমে যাবার সময় ও সুযোগ না দিয়ে আগুনে পোড়ানো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সহিংসতা। কারা তা করেছে তা খুঁজে বের করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নাভি পিল্লাইও তার হুঁশিয়ারিমূলক বিবৃতিতে, ‘আরোহী যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ না দিয়ে’ যানবাহনে আগুন দেবার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। প্রাণহানিতে নিহত মানুষ ফিরিয়ে আনা যায় না, অন্য সব তি হয়তো পূরণীয়। ফলে এ কাজ নিন্দনীয় এবং আন্দোলনের এই আওয়ামী ধরনকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পটকা বা ঘরে তৈরী বোমা এর আগেও ব্যবহার করা হয়। এবারও হয়েছে।
যেটা নতুন সেটা হচ্ছে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নামা মাত্রই পুলিশের গুলি চালানো। বুক ও মাথা ল্য করে হত্যার জন্য গুলি ছোড়া এর আগে ছিল না। নতুন প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্য অংশগ্রহণকারীদের থেকে শোনা, তারা বলছেন দশজনেরও একটা মিছিল নিয়ে যদি রাস্তায় নামতে চাই আর সাথে যদি দুইটা ককটেলও না থাকে তবে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে হবে। কারণ পুলিশ আমাদের দেখে ফেললে তাদের ভয় দেখানোর জন্য আমাদের কয়েক সেকেন্ড সময় দরকার, যাতে দ্রুত নিরাপদ একটা অবস্থানে সরে গিয়ে আশ্রয় জুটিয়ে নিতে পারি। এ কাজে ককটেলের ভয় দেখানো ধোঁয়া আর শব্দ একটু কাজের হয়, কিছুটা সময় দেয়। বেশ কিছু জায়গায়, বিশেষত রাজশাহী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দেখা গিয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সাধারণ পোশাকে কিছু ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিােভকারীদের ওপর হামলা করছে। রাষ্ট্র বা সরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস ও তার সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদেরই আশ্রয়ে মতাসীনদের দলীয় সহিংসতার এই ধরনগুলো অতীতে মুজিব আমলেও দেখা যেত। বলা বাহুল্য গণমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কিভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধকেই তাদের প্রপাগান্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। এই সময় কতজন মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং নির্যাতনে নিহত হয়েছেন এবং বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে কী পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছেÑ এই দুই পরিসংখ্যানের মধ্যকার ফারাক বিস্ময়কর। বাংলাদেশের বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে এত বড় হত্যাযজ্ঞ এর মাঝে ঘটেনি।
তবুও বলা দরকার যারা রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চান না, তাদের সংবেদনার সঙ্গে আমরা একদমই একমত। কিন্তু সেটা বন্ধ করতে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ওপর। নাগরিকরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র ও সমাজ তৎণাৎ ভেঙে পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন সংবিধান, আইন, মানবাধিকার কিম্বা নীতিনৈতিকতা, নাগরিক ও মানবিক অধিকার কিছুই মানে না, নিজেই নিজের নাগরিকদের বিচার ছাড়া হত্যা করে, তখন রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন সন্ত্রাস ও সহিংসতা যে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় তা অভীষ্ট ল্েয পৌঁছানো ছাড়া তুরীয় উত্তাপ থেকে নেমে আসা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা কমিয়ে আনা দ্বিতীয়ত নির্ভর করে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকার ওপর। যদি সরকারের নীতি হয় দিল্লির আত্মঘাতী রণনীতি বাস্তবায়নÑ অর্থাৎ যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইসলামপন্থীদের শারীরিক অর্থে নির্মূল, তাহলে আন্দোলনকে সহিংস করবার দায়দায়িত্ব ষোল আনা মতাসীনদের। অথচ আইনের শাসন ও শক্তিশালী নিরপে বিচারব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিচর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনার কার্যকর শর্ত তৈরি করা সম্ভব।
এমনিতেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরায় রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ এবং সব নাগরিককে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার সামর্থ্য আমাদের নাই বললেই চলে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি তখনই সম্ভব যখন নাগরিক অধিকারের সীমার মধ্যে সব ধরনের রাজনীতি ও মতাদর্শ চর্চা করার সুযোগ অবাধ থাকে। এই মৌলিক সূত্রের দিকে নজর ফেরানোর মতো রাজনৈতিক দিশা সমাজে ও সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বিএনপিও এসব দিকে খোঁজখবর রাখে বলে মনে হয় না, তাদের আগ্রহও দেখা যায় না। অথচ এটাই হতে পারত জনগণকে বিভক্ত নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করার মূলনীতি।
হাসিনার নয় দফার সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব গণ-আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে বিএনপি যারপনাই অস্পষ্ট, এখন অবধি আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে তারা গভীরভাবে ভাবেনি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার েেত্র নীতি ও কৌশল নির্ণয় করবার দুর্বলতাগুলো তাদের মধ্যে প্রকট। এটা এখন বেশি ধরা পড়ছে কারণ বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের েেত্র নির্ধারক হয়ে উঠেছে। বিএনপির নেতারা খেয়াল করলে দেখতেন, শেখ হাসিনা কিভাবে আন্দোলন করতে চাইছেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিরাট কোন থিসিস হাজির করেননি। যে বক্তব্য নির্বাচনী ইশতেহারে থাকার কথা সে বক্তব্য আন্দোলনের মাঝখানে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়াটাও দুর্বল সিদ্ধান্ত ছিল। এই মুহূর্তে সেটা ছিল বেদরকারি। মনে হয়েছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাটপেস্ট করে বেখাপ্পাভাবে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মাঝখানে কিছু বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা গত আন্দোলনে সরকার উৎখাতের কথাই বলেছিলেন, যে সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছেন, তাদের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেননি। সংবিধান ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কিভাবে ‘অবৈধ’ সরকার উৎখাত করতে হবে তার ফর্মুলাই তিনি হাজির করেছিলেন। সংবিধানের মধ্যে থেকেও কিভাবে মতাসীন সরকারকে উৎখাত করা যায় সে কথাই নয়টি দাবির মধ্য দিয়ে পেশ করেছেন। যে কারণে গত লেখা আমি নয় দফার ওপর লিখেছি।
খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলছেন, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে এই ধরনের সরকারকে উৎখাতের ফর্মুলাই জনগণ তাঁর কাছে চেয়েছে। শিখতে হবে, খালেদার বিরুদ্ধে যখন সহিংস আন্দোলন করছিলেন তখন ‘অবৈধ’ সরকারের সাথে সমঝোতা বা সংলাপ করতে হাসিনা চাননি, আহবানও জানাননি।

দুই.
হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কের সারকথা হচ্ছে জবরদস্তি ঢাকায় যারা মতায় রয়েছে তাদের ওপর দ্রুত নির্বাচন করবার জন্য মৃদু চাপ সৃষ্টি। ধারণা করা যায়, যে চাপই আসুক কাজ হবে না। শেখ হাসিনা খানিক বিরক্ত হবেন হয়তো, যথারীতি তিনি তা এড়িয়ে চলবেন। দণি এশিয়ার জন্য নির্ধারিত দিল্লির রণনীতিটাই তিনি অনুসরণ করবেন। তাঁর গণবিচ্ছিন্নতা বিবেচনায় রেখে নির্মোহভাবে বিচার করলে এই নীতি অনুসরণই তাঁর দিক থেকে সঠিক। তার সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। এর সঙ্গে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত দণি-পূর্ব ভারতের প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করবার মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা সমাধানের নীতি দিল্লির চোখ দিয়ে দেখতে হবে। দেখলে দিল্লির রণনীতি ও শেখ হসিনার রণরঙ্গিনী মূর্তি মোটেও ভুল বা মন্দ বলা যাবে না। অর্থাৎ দিল্লীর স্বার্থের দিক থেকে তাকালে এটাই উভয়ের জন্য সবচেয়ে লাভজনক নীতি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ সমূলে উৎখাত করতে চাইলে দিল্লির কাছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভাল সুযোগ ভবিষ্যতে দিল্লির জন্য আসবে কি না সন্দেহ। অতএব শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তভাবে সমর্থনই দিল্লি ঠিক মনে করছে। সম্ভবত এই ধরনের নির্বাচনই দিল্লি চেয়েছে। হাসিনার বিপে বাংলাদেশের জনগণের ভোট দেওয়া ও তাকে মতা থেকে সরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটাই দিল্লি রুখতে চেয়েছে। এখন অবধি দিল্লি ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ অর্থাৎ ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’দের দমন করা দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকারি বলে জনমত গড়তে পারছে। এটা ছল হলেও দিল্লি এখনো এতে সফল। সফলতার অর্থ হচ্ছে ভারতীয়দের এই প্রচারণায় বোঝানো যাচ্ছে, শেখ হাসিনাকে মতায় রেখে ইসলামপন্থীদের দমন করা না গেলে বাংলাদেশে আবার উত্তর-পূর্ব ভারত ও কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্যাম্প গাড়বে এবং সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের অভ্যন্তরে সহিংস কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। অতএব দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের এই রণনীতি ভারতের নিরাপত্তার জন্যই জরুরি। ঘন ঘন বাংলাদেশের অমুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিজে সৃষ্টি করে হলেও হিন্দু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমানদের হাত থেকে রা করার জন্য এই নীতিটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
অন্য দিকে দিল্লির ধারণা, বাংলাদেশের জনগণকেও বোঝানো যাচ্ছে এটা একাত্তর সালের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরে শক্তির রণধ্বনিও অভিন্ন। দিল্লির এই রণনীতির পে বাংলাদেশে শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশপন্থী গণমাধ্যম নাই বললেই চলে। সর্বশেষ দৈনিক ইনকিলাবও সিলগালা হয়ে গেল, তার প্রকাশনা আটকে দেয়া হয়েছে।
শাহবাগের আন্দোলন দিল্লির রণনীতির পে শক্তিশালী যুক্তি। শাহবাগের বিশাল ‘গণজাগরণ’ এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও নানান কিসিমের ইসলামি দলের হাত থেকে নিষ্কৃতি চায়। দিল্লি যুক্তি দিচ্ছে, এই ‘অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপে’ শক্তিকে ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত। অতএব একাত্তর সালে ভারতীয় সৈন্যসহ দিল্লি যেভাবে বাংলাদেশকে সরাসরি যুদ্ধে সমর্থন করেছিল সেই একইভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করে ইসলামপন্থীদের এখনই ‘নির্মূল’ করতে হবে। আফটার অল, এটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপ তখনই করা হবে যখন তিনি জামায়াত ও হেফাজতকে ত্যাগ করে আসেন। তিনি যদি না আসেন তাহলে বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরে নেতা ও কর্মীদের বড় একটি অংশই তাঁকে ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করবে এবং দিল্লির রণনীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দ্বিতীয় রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে উদ্ধৃত করে লেখায় তার মন্তব্য পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দিল্লি ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সকল প্রকার বিদ্রোহের সমুচিত জবাব দিতে চায়।
এটা ভাববার কোনই কারণ নাই যাঁরা শাহবাগে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা একে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গণ্য করেন তাদের সবার সঙ্গে দিল্লির এই রণনীতির আদৌ কোন সম্পর্ক রয়েছে। বরং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ শাহবাগকে সমর্থন দেওয়ায় শাহবাগের আন্দোলনের তি হয়েছে। বাংলাদেশের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যারা আন্তরিকভাবেই চেয়েছেন তাঁরা কোনভাবে দিল্লির এই রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নন। বিশাল একটি অংশ শেখ হাসিনার রাজনীতিরও সমর্থক কি না সন্দেহ। আওয়ামী লীগের প্রতি পপাত রয়েছে, কিন্তু দলটির এখনকার রাজনীতির সমর্থক নন তাঁদের সংখ্যাও শাহবাগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কম নয়। তবে ুদ্র একটি অংশ এখনো আওয়ামী রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
দিল্লির এই রণনীতির পে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ থাকবে এই অনুমানও ভুল। আমরা শুধু দাবি করতে চাইছি বেআইনি ও অবৈধ সরকারবিষয়ক সঙ্কট ও বর্তমান গণবিচ্ছিন্নতার কারণে শেখ হাসিনা বিপদে আছেন, দুর্বল তিনি। এই দুর্বলতার জন্য দিল্লির এই রণনৈতিক অবস্থানের ফাঁদে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে যেতে তিনি বাধ্য এবং তার পরিণতি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনবে না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন যে দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ঠিক হয় না। বরং ঠিক হয় সাউথ ব্লকে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে; আর তা ঠিক করেন আমলারা। এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির বর্তমান নীতি বাস্তবতাবর্জিত, এই নীতির মধ্যে প্রাজ্ঞতা, বিচণতা ও দূরদৃষ্টির প্রকট অভাব রয়েছে। শেখ হাসিনার দুর্বলতার সুযোগ দিল্লি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করছে। দিল্লির নিঃশর্ত সমর্থনের জোরে অন্যান্য দেশের প থেকে দেওয়া চাপ হাসিনা তোয়াক্কা করবেন না; এটাই বলতে চাইছি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফরাসি, ওলন্দাজ ও জার্মানদের বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষ অপরিচিত কিছু নয়। তারা শেখ হাসিনার ইসলাম দমনকে প্রশংসার চোখেই দেখে। দিল্লি জানে একটা পর্যায়ে ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের প্রতি ইউরোপের সমর্থন থাকবে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তিন.
এবার ‘গুজব’। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন আসমানি নেটওয়ার্কগুলো ‘বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি’র কথিত তথ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এবং ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সব তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও প্রেস সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তারা সেই কথিত তথ্যের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকারের কথাও ছেপেছিল। খবরটির শিরোনাম করেছিল, ‘সাতীরায় যৌথবাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা! : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকার’Ñ এভাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির খবর ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেটা অবশ্যই হতে পারে বা হয়তো আসলেই তা-ই। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ না করে গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর কারণে বিষয়টির মীমাংসা হবে না। বরং আরো জটিল হবে; সন্দেহকে আরো তীব্র করবে। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ভারতীয় গোয়েন্দারা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের এর আগেও ধরে নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভারতীয় অপারেটিভদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তৎপরতা চালানো নতুন তথ্য নয়। দ্বিতীয়ত নিজের দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, এ েেত্র তাদের অভিজ্ঞতাও প্রচুর। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সাতীরার পরিস্থিতি দমনে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন সরকার দিল্লির কাছে সামরিক সাহায্য চাইতেই পারে। দিল্লি নিজ দেশের বাইরে এই ধরনের গোপন অভিযানে অংশ নিয়েছে কি না সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তাই এই তর্ককে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
গুজব হোক কি সত্য হোক, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এই খবরের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের জনগণ কিম্বা বাংলাদেশের সরকার এই ধরনের গুজবের প্রতি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তার দ্বারা দিল্লির প্রতি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংবেদনা পরিমাপ করা যাবে। এই অঞ্চলে আগ্রহী প্রতিটি পরাশক্তি তাকে গুরুত্বের সঙ্গেই পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে দণি এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র কেমন হতে পারে তা এই প্রতিক্রিয়া থেকে আন্দাজ করা যাবে অনায়াসেই। দিল্লি চাইলেও এই ‘গুজব’কে হাল্কা করতে পারবে না।
অন্য দিকে ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত প্রাচীন ধারণা মাথায় রেখে শক্তিশালী দেশগুলো আজকাল আর কাজ করে না। সেটা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেÑ বিশেষত লিবিয়া, সিরিয়ায় দেখেছি। ফলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বিদেশী সৈন্য ঢুকে পড়তেই পারে। এটা অবাক হবার মতো কোন
অবাস্তব ‘গুজব’ নয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাই বলে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও দুর্বল দেশকে দিল্লি যেমন খুশি তার রণনীতির জন্য ব্যবহার করতেই পারে। করবে না কেন? দিল্লি যদি মনে করে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাহলে প্রকাশ্য বা গোপন যেকোন সামরিক অভিযান চালানো গোলকায়নের (গ্লোবালাইজেশনের) এই যুগে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরই অংশ। দিল্লি সেই যুদ্ধেরই আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটাতেই পারে। ফলে এই ‘গুজব’ শাঁখের করাতের মতো কাজ করবে। স্বীকার করলে যা, না করলেও তাই।
ফেসবুকে আফসান চৌধুরী ইতোমধ্যে জনমত বোঝার জন্য প্রশ্ন করে সবার কাছে জানতে চাইছেন, ভারতীয় সৈন্য যদি জানমাল রার জন্য সাতীরার অভিযানে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থন করা যায় কি না। যদি না যায় তার মানে একাত্তর সালে ভারতের সমর্থনÑ অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্য আমাদের রা করবার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ ও যুদ্ধ করার বিপইে আমরা তর্ক করছি। আর, ভারতীয় না হয়ে অন্য কোন দেশের সেনাবাহিনী যৌথ অভিযানে অংশগ্রহণ করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হোত কি না। আফসান চৌধুরী এই জনমত জরিপে কেন আগ্রহী হলেন তিনিই ভাল বলতে পারবেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য মতে যদি তা ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয় তবে সেই ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ‘গুজব’ নিয়ে মতামত জরিপের আয়োজনও কি সমান ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ নয়? এ ছাড়া এসব সেন্সেটিভ ‘গুজব’ নিয়ে ছেলেখেলাও মারাত্মক বিপজ্জনক সন্দেহ নাই। তবে তিনি ঠিকই ধরেছেন আমাদের সমাজে এইভাবে চিন্তা করবার মানুষও আছে। তাদের মতামত জানার চেষ্টা এক দিক থেকে অনেক প্রশ্ন তৈরি করলেও যে কারোরই এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে অন্যদের মত জানার অধিকার হয়তো আছে, কিন্তু উসকানির দিকটা উপো করবেন কী করে? আর মানুষের জানমাল রার নামে হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশান বা মানবিক অভিযান তো দেশে দেশে চলছেই। নিজের পছন্দের হলে জাতিসংঘও তা অনুমোদন করে।

চার.
এবার খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন-পরবর্তী বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় সবাই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে সমাজে ধারণা ও চর্চার যে পার্থক্য সেই তর্ক থাকলেও নানা কারণে দেশে একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় থাকুক এবং বর্তমান সংকটের একটি মীমাংসা হোক, সমাজের বড় একটি অংশ সেটাই চায়। যদিও আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি রাজনৈতিক বিভাজনের যে বিষে বাংলাদেশ আক্রান্ত, সেই বিষ থেকে মুক্তি খুব সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। সেই তর্ক এখানে নতুন করে তুলব না।
মাঠের আন্দোলনের ধরনে সাময়িক বিরতি দিয়ে খালেদা জিয়া ২০ জানুয়ারি গণসমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালো পতাকা মিছিলের ডাক দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা এবং বিএনপির চরিত্রের কারণে উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে খালেদা জিয়ার পে যাওয়া কঠিন। সেই দিক থেকে তাঁর বিরতির সময় নির্ধারণ ছিল সঠিক। বিশেষত হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বিতর্কের আগে আবারও সমঝোতার পথ খোলা রেখে নতুনভাবে আন্দোলন গোছানোর জন্য সময় নিয়েছেন তিনি। তার বক্তব্য ও অবস্থানের দুর্বলতা আগে উল্লেখ করেছি। এখন তার অর্জনের দিকগুলো বলব।
আন্দোলনে বিরতি দেওয়া ও সময় নেওয়াকে মতাসীনরা পরাজয় হিসেবে গণ্য করছে। মতাসীনদের পরে গণমাধ্যমগুলো আন্দোলনের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেবার জন্য এই দিকগুলো ফলাও করে প্রচারও চালাচ্ছে। বিএনপি একটি নির্বাচনের দল। ফলে নির্বাচনের বাইরে থাকা এই দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদপে। তার পরও বলা দরকার খালেদা জিয়া আন্দোলন মাঠে রেখে কোন আপোষের মধ্য দিয়ে এখনো মতায় যেতে চাননি; এই দিকটা স্পষ্ট। তবে সামনে খোলা দুটো পথের একটার দিকে তিনি হাঁটছেন এটাই আমরা হয়তো এখন দেখব। যদিও দুটোই ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ইত্যাদিতে ভরা।
প্রথম পথ; আপাতদৃষ্টিতে সহজ পথ। বিএনপির এখনকার চরিত্র আমলে নিয়ে কূটনৈতিক মহলের ওপর নির্ভর করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থাকা। এ পথেই তিনি থাকতে চান, আন্তর্জাতিক েেত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তিনি তা চাইলে দেখাতে পারেন। যদিও শেখ হাসিনা তাকে সে দিকে থাকতে দেবেন, নাকি ঘরে অথবা জেলে আটকে রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। শেখ হাসিনার সরকার বেআইনি ও অবৈধ। এই সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। দিল্লি ছাড়া প্রায় সব দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আদৌ কোন নির্বাচন বলে গণ্য করছে না। তারা নতুন নির্বাচন চায়। জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিএনপির দিক থেকে বিচার করলে এগুলো স্পষ্টই আন্দোলনের নগদ বিজয়ের দিক। তিনি মতার বাইরে আছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেটা সাময়িক। তাঁর মতায় যাবার পথ বাস্তব পরিস্থিতির নিজস্ব লজিকের কারণেই ঘটতে থাকবে। বেশ কিছু দেশের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাচ্ছে যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহনশীল ও উদার রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিকে দুর্বল করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশকে, তাদের ভাষায়, ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র’ পরিণত করা। ফলে নতুন নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এই দিক থেকে বিচার করলে আন্দোলন বিএনপির জন্য ইতিবাচক ত্রে তৈরি করেছে। এটা আমরা কমবেশি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
যদিও এই লেখার শুরুতে বলেছি গণ-আন্দোলন সহিংস থাকবে নাকি অহিংস হবে তা মূলত নির্ভর করে মতাসীনদের আচরণের ওপর। অর্থাৎ খালেদার ভূমিকা সেকেন্ডারি। আর দমন-পীড়নে মতাসীনেরা যদি লাভের গুড় বেশি দেখে তবে গণ-আন্দোলনকে সহিংস দিকে তারাই ঠেলে দেবে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে হাত-পা বেঁধে ঘরে বা জেলে রাখতে মতাসীনরা কুণ্ঠিত হবে না। আসলে এই পথে খালেদার সাফল্য নির্ভর করছে মূলত হাসিনার ওপর কূটনৈতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করা এবং সেই চাপের সাফল্যের ওপর। তার অর্থ তাকে দ্রুত আরেকটি নির্বাচনে বাধ্য করা। এই সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। এক কথায় বললে, পরাশক্তির ভাষায় বাংলাদেশকে ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র পরিণত করার’ বিপদ ঠিক তাদের মতো করে দেখতে হাসিনাকে এখনো তারা রাজি করাতে পারেনি; এমনকি রাজি করানোর ধারেকাছেও যেতে পারেনি। ফলে এপথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হবে কি না এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চূড়ান্তভাবে কী ধরনের চাপ পারাশক্তিগুলো শেখ হাসিনার ওপর প্রয়োগ করছে তার ওপর সেটা নির্ভর করবে।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় যে জয় সেটা হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক ও লিবারেল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দেওয়া। আমার মনে হয়, খালেদা জিয়ার মতায় যাবার চেয়ে আওয়ামী রাজনীতির এই ভণ্ড দিকটি উন্মোচন আন্দোলনের বিশাল সাফল্য। আওয়ামী লীগের যে ভাবমূর্তি ছিল, খালেদা জিয়া তা দেশে-বিদেশে মারাত্মকভাবে ুণœ করতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক তাঁরা দলটিকে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য সমর্থন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যারা সমালোচক তারা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছে যে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দল নয়। তাদের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবার প্রকটভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে। নিজের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উদ্ধার করা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই কঠিন হবে। যেসব এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনার জায়গাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এবারই প্রথম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ যারা নিজেদের ‘সেকুলার জনগোষ্ঠী’ মনে করে, তারা দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগকেও দায়ী করেছে। এর দায় একতরফা ইসলামপন্থী দল ও বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ সফল হয়নি।
খালেদা জিয়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী ও নাগরিকদের সুরার কথা বারবার বলেছেন, কিন্তু তাকে কার্যকর করবার েেত্র তার জোটের প থেকে সুনির্দিষ্ট কোন পদপে ও তৎপরতা দেখা যায়নি। হতে পারে, সরকারি দমন-পীড়নের মুখে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অজুহাত দেওয়াই যায়। কিন্তু দুর্বল ও অসহায় নাগরিকদের জান, মাল ও উপাসনার ত্রে এবং আক্রান্ত জনপদগুলোতে সরাসরি হাজির থেকে প্রাণ দিয়ে তাদের রা করার মধ্য দিয়েই বিএনপিসহ তার জোটের সদস্যরা বাংলাদেশের মর্যাদা অুণœ রাখতে সম হতে পারেন। এটাই একমাত্র পথ, কাগুজে ঘোষণা দিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবেই বরদাশনা করবার যে নীতির কথা খালেদা জিয়া বলেন, এবার তাকে যেকোন মূল্যে সেটা প্রমাণ করতে হবে।
তৃতীয়ত; আওয়ামী লীগ দিল্লির বশংবদ একটি রাজনৈতিক দল এই ভাবমূর্তি আরো গভীর হয়েছে। সাধারণ জনগণের বিশ্বাস অর্জন শেখ হাসিনার পে আগের চেয়েও তুলনামূলকভাবে কঠিন হবে। এ েেত্র কতিপয় গণমাধ্যমের নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও প্রপাগান্ডা কোন কাজে আসবে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিরন্তর দমন-পীড়ন ছাড়া শেখ হাসিনার পে রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।

পাঁচ.
খালেদা জিয়ার সামনে দ্বিতীয় যে পথ খোলা আছে সেটা কঠিন। সেটা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের পথ। সেই পথে তিনি অনেক দূর এসেছেন। আগামী দিনে কত দূর যাবেন এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তাঁকে ভেবে দেখতে হবে কূটনৈতিক মহল হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে আদৌ সম হবার সম্ভাবনা আছে কি না। ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি হাসিনা এই ধরনের চাপের তোয়াক্কা করেন না। খালেদা জিয়াকে ভাবতে হবে শুধু বাইরের চাপে শেখ হাসিনার অবৈধ ও বেআইনি সরকার পরাস্ত হবে না। যদি হোত সেটা অনেক আগেই ঘটত। কূটনৈতিক মহলের ঘাড়ে বসে একটা নির্বাচন পাবার সম্ভাবনা আগের চেয়ে এখন হয়তো একটু বেশি। কিন্তু কূটনৈতিক সমর্থন তা নিশ্চিত করবার জন্য যথেষ্ট নয়। খালেদা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও রক্তয়ী সংগ্রাম ছাড়া তা আদায় করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
শেখ হাসিনা গণবিচ্ছিন্ন এবং মতায় থাকার বৈধতা তাঁর নাইÑ এর সবই সত্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, শেখ হাসিনা নন, তাঁকে কার্যত লড়তে হচ্ছে দিল্লির বিরুদ্ধে। বিশেষভাবে দিল্লির দণি এশীয় রণনীতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বাস্তবতাই আজ নির্ধারক শর্ত। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত জনগণের সঙ্গে তিনি কত দূর যাবেন সেই সিদ্ধান্ত তাঁর।
ইতিহাসের সদর রাস্তায় সবাই হাঁটবার হিম্মত রাখেন না। তাঁদের সংখ্যা স্বল্পই হয়। খালেদা জিয়া নিজেকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন কি না, সেটা একান্তই তাঁর নিজের। দেখা যাক ভবিষ্যৎ আমাদেরকে কী দেখাতে পারে!

১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশিনগর।

Daily Naya Diganta
 
ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না
28 January 2014, Tuesday


এক.
গত ১৬ জানুয়ারি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রথম প্রস্তাবে সারা দেশে সহিংসতার বিস্তৃতি, বিশেষত সংখ্যালঘু ও অন্যান্য দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হরতাল ও অবরোধে জীবনযাত্রার ব্যাঘাত ঘটানো ও দুই পক্ষেরই, সরকার ও বিরোধী দলের, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসের নিন্দা করা হয়। প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শুধু বিরোধী দল সন্ত্রাস করেছে, এটা বলা হয়নি; আওয়ামী লীগকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার সরকারকে সরাসরি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সব ধরনের দমন-নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। শুধু জেল-জুলুম হয়রানির কথা বলা হয়নি, বরং এই দমন-নিপীড়নের মধ্যে রয়েছে নির্বিচার গুলি ও ‘প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র’ (live ammunition) ব্যবহার, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মানুষ মেরে ফেলা ইত্যাদি। এগুলো ভয়ানক অপরাধ। বাংলাদেশে যারা এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তাদের জানা দরকার যে, আন্তর্জাতিক মহল যখন এভাবে সুনির্দিষ্ট করে কোনো কিছু চিহ্নিত করে, তার মানে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে থেকে এ অপরাধ করে আপাতত পার পাওয়া গেলেও কোনো না কোনো সময় জবাবদিহি করতে হতে পারে।
নির্বাচনের আগে ও পরে যেসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ‘দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ’ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এটাও তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, আইন-শৃংখলা বাহিনীর যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদেরও যেন বিচারের অধীন আনা হয়। এই প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে খুবই কড়া প্রস্তাব। প্রস্তাবটি মূলত মানবাধিকার ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের পক্ষে নেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবের তাৎপর্য হচ্ছে, সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার নিন্দা; ক্ষমতাসীনরা মানুষ হত্যা করছে তার স্বীকৃতি। প্রথম প্রস্তাবের পরপরই দ্বিতীয় প্রস্তাব তোলারও তাৎপর্য আছে। সারা দেশে সহিংসতার বিস্তৃতির জন্য দুই পক্ষকে দায়ী করার পরও আলাদা করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিন্দা করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের যখন তখন গ্রেফতারেরও নিন্দা জানায়।
তৃতীয় প্রস্তাবে প্রথম প্রস্তাবের অনুসরণে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আরও সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি সহনশীল দেশ, তা স্বীকার করেই প্রস্তাবটি করা হয়েছে। কোথাও বলা হয়নি যে, বাংলাদেশে মৌলবাদী কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাণ্ডব করছে। কিংবা বাংলাদেশ তথাকথিত মৌলবাদীতে ভরে গেছে। এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের গরিব এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর নানা সময়ে নির্যাতন ঘটে। প্রস্তাবে শেখ হাসিনাকে বলা হয়েছে, যারাই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের বিবাদ উসকে দিয়েছে, সবাইকেই যেন ‘কার্যকর’ শাস্তি দেয়া নিশ্চিত করা হয় (ensure effective prosecution of all instigators of inter communal violence)। অপরাধীদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় লোকজনও অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের সরকার পছন্দের সুযোগ দেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এই কাজটি দ্রুত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। রাজনীতির দুই পক্ষ কোনো সমঝোতায় আসতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সব দিক বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে। দরকার হলে আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির যারা সমর্থক এটা তাদের দাবিকেই সমর্থন করে। বিশেষত বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এই দাবি করছে। আমি এর আগে আমার লেখায় অনেকবার বলেছি, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রধান বিরোধ হচ্ছে সুশীলরা গণতন্ত্র চায় না, অর্থাৎ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার কিংবা রূপান্তর তাদের দাবি নয়। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই জোড়াতালি বা তাপ্পি মেরে চলার পক্ষপাতী। তারপরও বলব, খালেদা জিয়ার যদি কিছু করার হিম্মত না থাকে তো তাড়াতাড়ি আরেকটি নির্বাচন হলেই বা খারাপ কী? যদি হয়!
উপরের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য পঞ্চম প্রস্তাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে সব রকম ‘উপায়’ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওদের অর্থ সাহায্যের কথাও বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায় কয়েকটি ইউরোপীয় সংস্থা বাংলাদেশ নিয়ে এবং বাংলাদেশে খুব সক্রিয় হয়ে উঠবে। যেমন, European Instrument for Democracy and Human Rights and the Instrument for Stability, Office of the Promotion of Parliamentary Democracy (OPED) ইত্যাদি। বাংলাদেশে যেসব এনজিও নির্বাচন নিয়ে কাজ করে তাদের আরও অর্থ পাওয়ার ভালো একটি সুযোগ হল। তারা তাদের প্রজেক্ট এপ্লিকেশন করা শুরু করে দিতে পারে।
ছয় নম্বরে গিয়ে জামায়াত ও হেফাজত নিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। সাত নম্বর প্রস্তাব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে। প্রস্তাবের সার কথা ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায় তা হল, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বলছে, তোমরা তো উভয়ে গণতন্ত্রী, এরকম একটা প্রচার আছে। তাহলে তোমরা পরস্পরকে সম্মান বা শ্রদ্ধা করতে শিখছ না কেন? শেখ। আদব-কায়দার সংস্কৃতি রপ্ত কর। এটা হল পাশ্চাত্য দেশগুলোর দেশীয় গোলামদের আদর-সহবত ঠিকমতো রপ্ত করার জন্য মধুর তিরস্কার।
ছয় নম্বরের উল্লেখযোগ্য দিক হল, বিএনপিকে জামায়াত বা হেফাজতে ইসলামকে সরাসরি ছাড়তে বলা হয়নি, কিন্তু তাদের কাছে থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। দূরত্বটা এমন হতে হবে, যাতে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাও সেটা কাতর অনুরোধ। কোনো হুমকি-ধমকি কিংবা কড়া নির্দেশ নয় (urges the BNP to unequivocally distance itself from Jamaat-e-Islami and Hafezat-e-Islam)। পরে মনে হয় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে যারা বিশেষ বিশেষ লবির পক্ষে প্রস্তাব নেয়ার জন্য তদবির করে বেড়ায় তাদের মধ্যে দিল্লিওয়ালারা আছেন। দিল্লিকে খুশি করার জন্যই এই লাইনটি ঢুকল।
এরপর সাত নম্বরে বলা হয়েছে, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে সেসব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে এমন কথা কোত্থাও বলা হয়নি। বরং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের যুক্তি মানলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করা সম্ভব। সেটা প্রমাণ করাও কঠিন কিছু না। অসুবিধা কী? সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সন্ত্রাসী। সহিংসতা ছাড়া তাদের কেউই রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারত না। সেটা দলীয় সন্ত্রাস হোক, কিংবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বিএনপিরও অতীত রেকর্ড ভালো নয়।
বাকি কয়েকটি প্রস্তাব আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বিডিআর বিদ্রোহের মামলার রায় সংক্রান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অপরাধ বিচার করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছে পার্লামেন্ট। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ সংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার বিধান বিলুপ্ত করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো। এর ফলে নাগরিকদের হয়রানি বাড়বে এবং সহজে নাগরিকদের ‘অপরাধী’ বলে অভিযুক্ত করা যাবে, যা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিলের দাবিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।
দুই.
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব ব্যাখ্যা করে লেখা শুরু করলাম, কারণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার সহযোগী গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের মূল সুরই নাকি বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা। এটা ডাহা মিথ্যাচার। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব আসলে ভারসাম্যের দিক থেকে বিএনপির দিকে, ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কতিপয় গণমাধ্যমের চিৎকারের চোটে বিএনপি ভড়কে গেছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে পরাশক্তিগুলোকে খুশি করার ভুল চিন্তা বিএনপির মাথায় আবারও ভর করেছে বলে মনে হয়। বিএনপির মধ্যে এক দঙ্গল দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ ভাবতেই পারে, কোনো আন্দোলন সংগ্রাম না করলেও ঢাকার কূটনৈতিক মহল তাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেবে। যাতে তারা আবার লুটপাট করতে পারে। আফসোস, এরকম দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত ক্ষীণ! মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে বিএনপির মহাসচিব পদে বসিয়ে দিলেও সেটা সম্ভব কি-না সন্দেহ! খালেদা জিয়াকে আন্দোলনেই থাকতে হবে। রাস্তায় যারা জনগণের অধিকারের জন্য মরছে, পঙ্গু হয়ে ঘরে কাতরাচ্ছে, তারা যে দলেরই হোক, একবার তার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করলে তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তিন ঐতিহাসিক ধারার সন্ধিস্থল হিসেবে। এক. ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এ দেশের আলেম-ওলামাদের লড়াই এবং তার সঙ্গে যুক্ত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রাম, যাদের অধিকাংশই ছিল ধর্মসূত্রে মুসলমান- যারা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের জন্য যারা অস্ত্র ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিক জিয়াউর রহমান যাদের কাছে নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান নন। শেখ মুজিবুর রাজনীতিবিদ ছিলেন সন্দেহ নেই। তার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে। কিন্তু জিয়া বাংলাদেশের জনগণের বিশাল একটি অংশের কাছে সৈনিকতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মিলন চিহ্ন। বিএনপির ভুল রাজনীতির কারণে যা ম্লান হয়ে যেতে বসেছে। তিন. ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যারা দিল্লির আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন মেনে নেয়নি। লড়েছে। যদিও এদের অনেককে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে খালেদা জিয়া র‌্যাব গঠন করে হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান যা করেননি খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জন্য সেই কাজই করেছেন। এর ফলে বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার কাছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। অতীত কর্মকাণ্ড ও ইতিহাস বিচার এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে এখনকার শত্র“মিত্র চিনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই বিএনপির এখনকার কাজ। যেমন- ইসলামপন্থীরা বিএনপির মাথার ওপর বোঝা নয়, শক্তি। যদি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে খালেদা জিয়া তার দলকে গড়তে চান তাহলে বামপন্থীরা এ মুহূর্তে তার শত্র“ নয়, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিত্র। অথচ এসব ইতিহাস ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার দল পিছিয়ে আছে বিপজ্জনকভাবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি প্রণয়নে তার অস্পষ্টতা ও সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, দোদুল্যমানতা ও ত্র“টি তাকে দ্রুত এমন এক গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গৌণ হয়ে যেতে পারেন।
ইসলামপন্থীদের দূরে ঠেলে দেয়া নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্র কায়েমের জন্য কী ধরনের কর্মসূচি ও পদক্ষেপ দরকার সে বিষয়ে আন্দোলনে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে অবিলম্বে আলাপ-আলোচনা শুরু করাই এখনকার কাজ। প্রকাশ্যে সবার সঙ্গে বসে আন্দোলনের ভুল-ত্র“টি নির্ধারণ করা এবং প্রয়োজনে আÍসমালোচনাই তাকে জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। খালেদা জিয়া ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র’ রক্ষার কথা বলেছেন। তার জন্য তিনি কমিটি গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাকে খোঁজ নিতে হবে কেন এই কমিটিগুলো গড়ে ওঠেনি। কারা বাধা দিয়েছে? আর যদি গড়ে উঠেই থাকে, তবে সেগুলো কোথায়? কই?
অন্যদিকে যদি কর্মসূচির কথা বলি, তাহলে আদতে তিনি তো এক দফা কর্মসূচি দিয়েই দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা করা। এই কথাটাই বারবার জনগণের কাছে তাকে বলতে হবে। কিন্তু নিজের দেয়া কর্মসূচি তিনি নিজেই বারবার আড়াল করে দিচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনে লম্বা থিসিস পেশ করা রাজনৈতিক নেতাদের মানায় না। লিখিত বক্তব্যও নয়। সরাসরি নিজের মনের কথা জনগণকে পেশ করার মধ্য দিয়েই তিনি আসলে কী চাইছেন সেটা সাধারণ মানুষ বুঝে নেবে। আর ওই একটি দাবিই বাংলাদেশের জনগণের এখনকার একমাত্র কর্মসূচি। একমাত্র গণদাবি। তিনি নিজে এই কর্মসূচিতে বিশ্বাস করেন আশা করি। তাহলে ভাঙা রেকর্ডের মতো সমঝোতা, আলোচনা, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদি পুরনো ও অর্থহীন কথাবার্তা তাকে পরিহার করতে হবে। এসব বারবার শেখ হাসিনার কাছে চেয়ে, হাত পেতে, তিনি নিজেকে তামাশার বস্তুতে পরিণত করছেন। সেই হুঁশটুকুও তিনি হারাতে বসেছেন।
এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তারা মনে করে তিনি শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের রাস্তায় নামতে বলছেন। অন্যদিকে যারা জনগণের অধিকার হরণ করেছে তাদের দয়ায় ক্ষমতায় যেতে চান। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে শুধু তাকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য জনগণ গুলির মুখে বুক পেতে দেবে? এটা আশা করা কি ঠিক? এটা অবশ্যই ঠিক যে, বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই সমর্থন রয়েছে। কিন্তু সেই দাবির অর্থ তখনই থাকে, যখন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করার সুযোগ ক্ষমতাসীনরা দেয়। জনগণ আন্দোলনে নেমে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে তত্ত্বাবধায়কের দাবি নিয়ে শুরু হলেও রাজনীতির মূল ইস্যু নির্বাচনকালীন সরকারের ধরনের মধ্যে আর আটকে নেই, বরং খোদ ক্ষমতার বিদ্যমান চরিত্র মোকাবেলা করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। অতএব ক্ষমতাসীনদের পরাস্ত করা ও ক্ষমতার গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি সামনে চলে এসেছে আন্দোলনের নিজস্ব লজিক অনুযায়ী। আন্দোলন সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অতএব এখনকার গণদাবি হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। এই উপলব্ধি না ঘটলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব। এই উপলব্ধির অভাব ঘটলে খালেদা জিয়া কোনোভাবেই আর সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন না।
শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও এখন, তামাশার নির্বাচনের পরে, এই সাধারণ সত্যটুকু বোঝে, কিন্তু বিএনপি সম্ভবত বোঝে না। দিল্লির ভূমিকা সবার কাছেই পরিষ্কার। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও দিল্লির ভূমিকা বিপজ্জনক। পুরা দক্ষিণ এশিয়া অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। গত নির্বাচন যে নির্বাচন নয়, আর ক্ষমতাসীন সরকার যে আসলে বাংলাদেশের বৈধ কর্তৃত্ব নয়, এটাও সবার কাছে পরিষ্কার। মুখে বললেও বিএনপির কাছে এর কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মানে পরিষ্কার কি-না সন্দেহ। যে কারণে এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করতে চায়, সেটা পরিষ্কার নয়। দেশের মানুষের কাছে যেমন পরিষ্কার নয়, তেমনি বিদেশীদের কাছেও না- কারও কাছেই না। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক জনমতের সুযোগ নিয়ে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার এক দফাকে সামনে রেখে পরিষ্কারভাবে একটি বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়নই এখনকার কাজ। উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। জনগণের দিক থেকে বিচার করলে রাজনীতির যে মেরুকরণ ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পর্যায় অতিক্রম করে যাওয়ার এটাই একটি মাত্র পথ।
রাজনৈতিক অস্পষ্টতা থেকে দ্রুত নিজেকে মুক্ত না করলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া নিজেকে গৌণ করে তুলবেন। আন্দোলন ছাড়া তার সামনে কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি বিপ্লবী দল নয়, বুর্জোয়া দল। ঠিক আছে। কিন্তু বুর্জোয়া দল আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক আছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দেশে-বিদেশে সব পক্ষের কাছে আন্দোলনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার নীতি ও কৌশল নিয়ে অনেক কিছুই ভাবার আছে। অবশ্যই। কিন্তু তিনি দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের দলনেতা হবেন নাকি জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষায় সাড়া দিয়ে তাদের ‘আপসহীন নেত্রী’ হবেন, সেই সিদ্ধান্ত একান্তই তার।
২৭ জানুয়ারি, ২০১৪। ১৪ মাঘ, ১৪২০

উৎসঃ যুগান্তর


বিডিটুডে.নেট: ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না

http://www.onbangladesh.net/columndetail/detail/81/3310#
 
ইউরোপের পার্লামেন্ট ও বাংলাদেশের রাজনীতি
29 January 2014, Wednesday

১.
সোজা-সরল সাধারণ মানুষগুলোকে ধোঁকা দেওয়া সহজ

তথাকথিত ‘নির্বাচন’ নামক তামাশার পরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বেশ কিছু প্রস্তাব নেয়। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম পার্লামেন্টে গৃহীত অনেকগুলো প্রস্তাবের মধ্যে সব বাদ দিয়ে বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্কছেদ ঘটাতে হবে বলে হইচই শুরু করে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ইউরোপিয়ানদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক ছিন্ন করাই সাহেবদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয়েছে, বিএনপি এতে ঘাবড়ে গিয়েছে। ভড়কে গিয়ে বিএনপি ইসলামপন্থিদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইছে এই গুজবও ছড়িয়েছে বেশ। তাই ‘ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না’ শিরোনামে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলো ধরে ধরে আরেকটি দৈনিকে আলোচনা করেছি (দেখুন দৈনিক যুগান্তর ১ জানুয়ারি ২০১৪)। দেখাতে হয়েছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের প্রায় সবগুলোই মতাসীনদের বিপ।ে ঘাবড়ে যাবার কথা শেখ হাসিনার। খালেদা জিয়া তাহলে কেন আন্দোলনে বিরতি দিলেন সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের সোজা-সরল মানুষগুলোকে ধোঁকা দেওয়া সহজ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর সরকারি প এই দুর্বলতা জানে। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল ভুয়া, সেটা কূটনীতিবিদেরাও মানেন। শুধু তাঁদের ভাষা ভিন্ন, ‘নট ক্রেডিবল’ কিন্তু কথা একই। সেই ভুয়া নির্বাচন হয়ে যাবার পর বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একটি প্রস্তাবকে এত বেশি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে, যাতে মনে হয় ইউরোপিয়ানরা নতুন কাজ হাতে নিয়েছে। সেটা হোল, খালেদা জিয়াকে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ও সংসর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য করা। তারাই নাকি সকল সন্ত্রাস ও সহিংসতার মূল কারণ। ১৬ জানুয়ারিতে গৃহীত অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তাদের প্রচারের কোলাহল দিয়ে বেমালুম গায়েব করে দেবার চেষ্টা হয়েছে।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আসলে কী এবং তাদের প্রস্তাব আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি না এ ব্যাপারে বাংলাদেশে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। যে কারণে মতাসীনদের সমর্থক গণমাধ্যমগুলোর কোলাহলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করা উচিত জনগণ বুঝে উঠতে পারছে না। গণ-আন্দোলনের তরফে যার বিচারক জনগণ। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। অতএব আগের লেখারই সম্পূরক হিসেবে এই লেখা। এই লেখাটির সাথে ‘ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না’ লেখাটি পড়ে এলে খুশি হবো।

‘পার্লামেন্ট’ কথাটার একটা বিশেষ ধরনের দ্যোতনা আছে। ধরে নেওয়া হয় এখানে আইন প্রণয়ন করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে অনেকেরই ধারণা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট মানে যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য আইন তৈরি হয়। কিন্তু পৃথিবীতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টই এমন এক পার্লামেন্ট যা আসলে ‘পার্লামেন্ট’ নয়। যেখানে ‘কার্যকর’ আইন পাস করা হয় না। ‘কার্যকর’ কথাটা বলছি এ কারণে যে যদি প্রস্তাব পাস ছাড়াও তেমন কিছু হয়, তার চরিত্র প্রধানত কাগুজে ব্যাপারই হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সঙ্গে মিলে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এক ধরনের ‘আইন’ পাস করে বটে, কিন্তু সেগুলোকে আইন বলা মুশকিল। আধুনিক রাষ্ট্রে যাকে আইন প্রণয়নী সংস্থা (legislative assembly) বলা হয়, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সেই অর্থে সত্যিকারের আইন বা বলবৎযোগ্য আইন প্রণয়নের অধিকারী নয়। সেই অধিকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় পার্লামেন্টের। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কোন প্রস্তাব ইউরোপীয় রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বিবেচনায় নিতে পারে, কিম্বা না-ও পারে। কোন বাধ্যবাধকতা নাই। এই অর্থে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব কোন আইনের মতা বা কার্যকারিতা ধারণ করে না। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলেরও আইন প্রণয়নের কোন ‘আইনি মতা’ (legislative power) নাই। লিসবন চুক্তির (Treaty of Lisbon) মধ্যে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কাজের পরিধি ও মতা সীমাবদ্ধ। দুই হাজার নয় সালের ডিসেম্বর থেকে লিসবন চুক্তি কার্যকর হওয়া শুরু করেছে। বলা হয়, চুক্তির কার্যকারিতার ফলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মতা বেড়েছে, সেটা কোনভাবেই আইন প্রণয়নী মতা নয়।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এত কিছুর খবর জানে না। ফলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন প্রস্তাব তোলা হলে তাকে তারা অতিরিক্ত রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলে, বুঝতে পারে না। একে তো বিদেশীরা কিছু বললে মানুষ ভড়কে যায়, তারপর আবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। বিশেষত শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এই বিকার প্রবল। দুই শ’ বছরের বিদেশী শাসনে রপ্ত অভ্যাস তো সহজে যাবার নয়। এই শ্রেণীরই অনেকে মনে করে বাপ রে বাপ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে যখন প্রস্তাব পাস হয়েছে তখন সারা ইউরোপে বুঝি এই প্রস্তাবই রীতিমতো আইন হয়ে যাবে। টেলিভিশান টকশোতে দেখেছি শিতিদের কথাবার্তা এই ধারার। এতে সাধারণ মানুষ কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায়। বিদেশীদের কথাবার্তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

আসলে নৈতিক গুরুত্ব ছাড়া ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব আর কোন তাৎপর্য বহন করে না। নৈতিক গুরুত্বের অর্থ কোন ঘটনাকে নৈতিক ভাবে বিচারের েেত্র জনগণের মতামত প্রভাবিত করা। বাংলাদেশে হিংসা ও সন্ত্রাস ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। নৈতিক দিক থেকে এটা বন্ধ করা উচিত। খালেদা জিয়াকে বলা হোল জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে আপনি দূরে থাকুন। এতে ইউরোপে একটা জনমত তৈরি হোল যে বিরোধী দলের উচিত ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে দূরে থাকা। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের অনুমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই গণতন্ত্রী দল, কিন্তু এখন বাগড়া বাধাচ্ছে ইসলামপন্থীরা। ইসলাম গণতন্ত্রবিরোধীও। শুধু তা-ই নয়, ইসলাম একটি বর্বর ও হিংস্র ধর্ম, এরা ধর্মের নামে জেহাদ করে। খ্রিষ্টীয় ইউরোপে এই বর্ণবাদী চিন্তার আধিপত্য প্রবল। ফলে বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে। এতে অবাক হবার কিছুই নাই।

২.
তবু আমি বিস্মিত!!!
তবে আমি অন্য কারণে অবাক হয়েছি। আওয়ামী লীগপন্থী লবিওয়ালা আর ও দিল্লির প্রচারের পরও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলেনি, সহিংসতা ও সন্ত্রাস শুধু ইসলামি দলগুলোই করেছে; আর, মতাসীনরা ধোয়া তুলসী পাতা। না, বরং উভয় পকেই নিন্দা করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে এখন প্রতিষ্ঠিত যে আওয়ামী লীগ নিজেও একটি সন্ত্রাসী ও সহিংস দল। অতীতে লগি-বৈঠার মতো ঘটনা ঘটাবার পরও এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। এটা একটা বিরাট ঘটনা। এই পরিপ্রেেিতই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট একটা গড়ে হরিবোল প্রস্তাব পাস করেছে। সেটা হোল, সকল পকেই সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করতে হবে।

বিস্মিত হবার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সরাসরি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে হবে এটা কোত্থাও বলা হয়নি। ইউরোপকে আমি যতটুকু জানি তাতে এই প্রস্তাব পাস হলে আমি মোটেও বিস্মিত হতাম না। মতাসীনদের পরে গণমাধ্যম এই মিথ্যা প্রচারে মুখের ফেনা বের করে দিয়েছে। পার্লামেন্ট বরং বলেছে, যেসব দল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে (Stresses that parties which turn to terrorist acts should be banned )। যেকোন দলই সেটা হতে পারে। অর্থাৎ এই দোষে আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায়। ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরুদ্ধে পাল্টা বল প্রয়োগ করেনি, এটা দাবি করা যাবে না। করেছে, না করলে তারা এত দিনে চিনাবাদাম হয়ে যেত। কিন্তু আসলে কী ঘটেছে, কার কী ভূমিকা তার একটা নির্মোহ অনুসন্ধান দরকার আছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো ‘দ্রুত, স্বাধীন ও স্বচ্ছ’ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দেবার কথা বলা হয়েছে। বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আসলে মতাসীনদের নিন্দাই করছে। অথচ বাংলাদেশের মতাসীনদের পাবলম্বনকারী গণমাধ্যম উল্টা প্রচার করছে। ইউরোপে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ভাবছে, কেমন করে ভাবছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা কী জানে আর কী জানে না পার্লামেন্টের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে এই সকল দিক ভালভাবে আন্দাজ করা যায়। কারা কী প্রস্তাব করছে এবং কারা সমর্থন করছে তা বিচার করে কারা বাংলাদেশের পে বা বিপে সক্রিয় সেটাও বোঝা যায়। দ্বিতীয়ত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মতামত গঠনে কিছুটা ভূমিকা রাখে। প্রস্তাবের গুরুত্ব অতটকুই। তার বেশি কিছু নয়।

তো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের গুরুত্ব কেমন তা বোঝাবার জন্য একটা নজির দিচ্ছি। ২০ নভেম্বর ১৯৯৭ সাল। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট প্রস্তাব নিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। পাহাড়ের ‘বেসামরিকীকরণ’ করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ি অধিবাসী বা ‘জুম্ম জাতি’র স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাংলাদেশ সরকারকে মানতে হবে। পাহাড়ে শুধু আদিবাসীরাই থাকবে আর কেউ নয়। বাঙালি সেটেলারদের পাহাড় থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। ঠিক এখন যেমন বাঙালিদের ‘সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বিশুদ্ধতা’ বজায় রাখার জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামকে ‘নির্মূল’ করবার কথা আমরা শুনি। আমি কে তুমি কে? বাঙালি বাঙালি। তো এখানে কেউ নিজের মুসলমান পরিচয় অন্য সব পরিচয়ের তুলনায় অন্যতম বা প্রধান গণ্য করবে কেন? সে নিশ্চয়ই রাজাকার, কিম্বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। আর নিজেকে আগে মুসলমান পরে বাঙালি গণ্য করেও বা বাংলাদেশে বাস করবে কিসের অধিকারে? ইউরোপ নিজেকে জাতিগত বর্ণবাদ থেকে মুক্ত ভাবলেও এই ধরনের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে তাদের অন্দরমহলের আবর্জনা আমরা টের পাই। আর ইউরোপীয় চিন্তা কোকাকোলার মতো পান করে যারা আধুনিক ও ধর্মনিরপে হয় তাদের বর্ণবাদ বুঝতেও সুবিধা হয়।
মজার কথা হোল, সেটেলারদের সরিয়ে নেবার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থসাহায্য করতেও রাজি ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা জুম্ম জাতির অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের পাহাড় থেকে সরিয়ে সমতলে নতুন বসতি নির্মাণ করবার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উন্নয়ন বরাদ্দের অভাব হোত না। এখনো তারা এ কাজে সম্ভবত রাজি। তো সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমরা যে দিক থেকেই দেখি সেটা প্রস্তাব হয়েই থেকে গেছে। বাস্তবায়িত হয়নি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবের রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝাবার জন্য উদাহরণটা দিলাম। (প্রস্তাবের ইংরেজি ভাষ্য : Urges the Government of Bangladesh to review its demographic policy, to relocate the Bengali settlers from CHT and rehabilitate them in the plains, in full respect of their rights and with the full use of the financial assistance of the European Union)। আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বর্ণবাদ গণ্য করি এবং ুদ্র জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আমি ঘোর সমর্থক। বাংলাদেশের যেকোন নাগরিকের মতো পাহাড়ের জনগণের নিজেদের সম্পত্তির ওপর অধিকার কায়েমও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অন্তর্গত। অর্থাৎ আমি খালি ুদ্র জাতিসত্তার তথাকথিত সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে সন্তুষ্ট নই, কারণ সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন বাদ দিয়ে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কোন অর্থ নাই। ুদ্র জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আমি চাই কারণ জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্বিশেষে বাংলাদশে একটি ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির বিকাশ’ ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারবো না। ‘বাঙালি’ বলি, ‘জুম্ম’ বলি আমরা এখনো ‘জাতিবাদী’ জনগোষ্ঠি রয়ে গিয়েছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নই, যারা বৈচিত্র্যের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যচর্চা করে। ফলে একক ও অখণ্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি গঠনে আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। আমরা তিন দিকেই শত্রু পরিবেষ্টিত, ফলে একক ও অখণ্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি গঠন ছাড়া আমাদের বিকল্প নাই। আমাদের একটি শক্তিশালী দেশ দরকার। বাংলাদেশের প্রতিরা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যা প্রাথমিক শর্ত।

ুদ্র জাতি সত্তার আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং বাংলাদেশে প্রত্যকের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের দেশ হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি; কোন বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক আদর্শ দ্বারা নয়। এ কারণে শেখ হাসিনার শান্তিচুক্তির মতো গরু মেরে জুতা দান কোন রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না। যে কারণে পাহাড়ে শান্তিও আসেনি। সমস্যারও সমাধান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা মাত্র নয়, বরং সরাসরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংকট।
এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উদাহরণ দিয়েছি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবের মানে বোঝাতে। ইউরোপ কিভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত এবং আমাদের নিয়ে ভাবে সেটা বোঝা দরকার। যেহেতু আইনি গুরুত্ব নাই, আমরা চাইলে উপোও করতে পারি। শেখ হাসিনা যেমন এটা জানেন, অতএব তাকে উপোও করবেন। কিম্বা এই সব প্রস্তাব সাহিত্য বা সমাজতাত্ত্বিক মালমসলা হিসেবে পড়া যেতে পারে। যেহেতু আইনি গুরুত্ব নাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউরোপ যা খুশি প্রস্তাব নিতেই পারে। ওপরের উদাহরণ যেমন। তাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে ইউরোপকে বেশ বোঝা যায়। এর গুরুত্বই বা কম কী!

তবু বলব, আইনি কার্যকারিতা না থাকুক, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত। ইউরোপের কথা শোনার মধ্যে দোষ কিছু নাই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের নৈতিক ওজন তো আছেই। সেটা আবার অস্বীকার করা বেয়াকুবি। ঠিক তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স কিম্বা মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে তর্কবিতর্ক ও প্রস্তাবকেও। ইউরোপীয় পার্লেমেন্টের তুলনায় তারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সিদ্ধান্তের আইনি পরিণতির সম্ভাবনা থাকে।
বিদেশীরা তাদের পার্লামেন্টে, সিনেটে বা আইনসভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তার মধ্যে ইউরোপীয় মন ও তাদের চিন্তার ধরন, স্বাভাবিক কিম্বা অ্যাবসার্ড বা আজিব যা-ই হোক, বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যান্য রাষ্ট্র ও তাদের জনগণের মনমানসিকতা, চিন্তার প্যাটার্ন, ঝোঁক, অভ্যাস, ঐতিহ্য, ইতিহাস ইত্যাদির হদিস রাখলে সময়ে আজে আসতে পারে। বিশ্বসভায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসেবে আমাদের টিকে থাকার জন্যই এটা দরকার। অনেকটা সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট বা নিজেকে রার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির চর্চা হিসেবে জারি রাখা। এতে লাভ ছাড়া তি নাই।

বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের জায়গা মজবুত করতে হলে যেকোন ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব বা পরামর্শে সাড়া দেওয়া, আর অন্যায় প্রস্তাবের বিরোধিতা করাই সঠিক কাজ। গোলকায়নের (globalization) এই যুগে আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গণ্য করতে পারি না। সবাই সবার সঙ্গে কোন-না-কোনভাবে যুক্ত। অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই আমাদের নিজেদের পথ বের করতে হবে। তবে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ একমত হওয়া নয়, কিম্বা সব কথাতে সায় দেওয়াও নয়। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা কিম্বা এশিয়ায় সাধারণ মানুষ বিশ্বব্যবস্থায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়ছে। সে লড়াই অধিকাংশ সময় সশস্ত্র রূপ গ্রহণ করে। সহিংসতা কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সশস্ত্রতা ও সহিংসতা দিয়ে হরণ করা হয়, সেই অধিকারহীন অবস্থায় শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলে না। সেই সম্পয় জনগণকে শান্তির কথা বলা বাস্তবসম্মত নয়। দেখা যাক।

৩.
বরং কে কিভাবে ইউরোপকে বুঝল সেটাই ইন্টারেস্টিং
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক তাদের প্রস্তাবে মোটেও নয়। বরং তাদের প্রস্তাবকে বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক প কে কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন ও গ্রহণ করেছে সেখানে। আমাদের আলোচনার বিষয়ও আসলে সেটাই। শেখ হাসিনা জানেন এই ধরনের প্রস্তাবের কোন মূল্য নাই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রায় এগারোটি প্রস্তাবের একটি প্রস্তাব ছাড়া বাকি সবই শেখ হাসিনার বিপ।ে তিনি তার থোড়াই কেয়ার করেছেন। শেখ হাসিনা জানেন, দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিজের সংগঠন ও শক্তির ওপর। মুখে প্রপাগান্ডা হিসেবে যা-ই বলা হোক, তিনি জানেন তাঁর সরকার একটি বে-আইনি ও অবৈধ সরকার। সারা বিশ্ব তাঁকে নিন্দা করছে, কিন্তু তিনি কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না। করবেন বলে মনে হয় না।

ইউরোপিয়ান পার্লেমেন্টে তাঁর খুনোখুনির নিন্দা করে প্রস্তাব নেবার পরও আইনশৃংখলা বাহনী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করছে। কারণ দুনিয়াতে তিনিই প্রথম নিষ্ঠুর ও নির্মম একনায়কতান্ত্রিক শাসক নন। আরো ছিল, আরো আছে এবং ভবিষ্যতে আরো আসবে। তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিম্বা ইউরোপ কি কাজ করছে না? করছে। অতএব তাঁর সঙ্গেও করতে হবে। বল প্রয়োগের শক্তিই প্রধান শক্তি।

অথচ খালেদা অবিলম্বে কাবু হয়ে গিয়েছেন। কিম্বা কাবু হবার জন্যই তিনি তৈরি ছিলেন। তিনি শান্তির পে আন্দোলনে ছেদ দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কর্মসূচিতে সাময়িক বিরতি দেওয়াকে আমি এর আগে একটি লেখায় সঠিক বলেছি। কিন্তু কত দিন? নতুনভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি দেবার আগে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মূল্যায়ন তাঁর জানা দরকার ছিল বলেই ‘সাময়িক বিরতি’কে সঠিক বলেছি। ধারণা করেছিলাম ভেবেচিন্তা ২০ তারিখের সভায় তিনি আরো কংক্রিট কর্মসূচি এবং আন্দোলনের আগামি পদপেগুলো স্পষ্ট করবেন। নিদেনপে সাংগঠনিকভাবে নিজেকে সংহত করবার জন্য ‘সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা’ রা কমিটি গঠনের ওপর জোর দেবেন। তিনি সেটা করেননি।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে জামায়াত ও হেফাজত-সংক্রান্ত প্রস্তাব ছাড়া বাকি সবই মূলত তাঁর পরেই প্রস্তাব। প্রত্যেকেই এই নির্বাচনকে ভুয়া (not credible) নির্বাচন বলেছে এবং আবার দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এর পূর্ণ সুযোগ তিনি নিতে পারতেন। কিভাবে নেবেন সেটা তো পরের কথা, বরং ইউরোপকে খুশি করবার জন্য জামায়াত ও হেফাজত ছাড়ছেন ইঙ্গিতও দিয়ে দিয়েছেন। অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়েই বলেছে। কিন্তু বিএনপি জামায়াত বা হেফাজত ছাড়ুক সিনেট বা হাউস অব কমন্স এই দাবি করেনি। প্রথমত হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয়, তাকে ছাড়া-না-ছাড়ার কথা তোলা অবান্তর ও হাস্যকর। জামায়াত সংসদীয় রাজনীতির কারণে জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তবে শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কারণ আন্দোলনের মিত্রে পরিণত হয়েছে। বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলা আর পার্লামেন্টারি রাজনীতি পরিত্যাগ করতে বলা সমার্থক। কিম্বা মতাসীনরা বলতে পারে আমরা হিংসা ও হত্যার রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি, অতএব আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য বিএনপি আর জামায়াতের আর জোট বাঁধার দরকার নাই। আমরা ভাল হয়ে গিয়েছি, আমাদের আর ভয় পাবার কারণ নাই। যারা কাণ্ডজ্ঞান হারায়নি তারা বিএনপিকে জামায়াত থেকে দূরে থাকবার কথা তাই বলবে না। সে কারণে এটা মার্কিন কিম্বা ব্রিটিশ দাবি নয়। ইউরোপিয়ানদের কাণ্ডজ্ঞান নাই এটা বলার দুঃসাহস আমি করি না। তবে বেগম জিয়া বোঝেন কি না জানি না, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এই দাবি আসার একমাত্র কারণ ভারতীয় প্রভাব, আর কিছুই নয়। ইউরোপ দিল্লিকে খুশি রাখতে চাই। এই আর কী!

বলাবাহুল্য, বিএনপির ২০ তারিখের সমাবেশে জামায়াত এবং হেফাজতের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রবল গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির অবশ্য দাবি করেছেন, তারা জামায়াতকে ছাড়ছেন না। কিন্তু বেলুন থেকে বাতাস বেরিয়ে গেলে তাকে ফুলিয়ে তোলা কঠিন। আবার ফোলানোর যন্ত্রের দরকার হয়। সেই যন্ত্র বিএনপির আছে কি? জনগণ ভেবেছিল বিদেশী প্রচারে কান না দিয়ে খালেদা জিয়া কিভাবে তাঁর জোটকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করবেন সেই দিকনির্দেশনাই দেবেন। দেননি। হয়তো কিভাবে সেই নির্দেশনা এখন সেটা স্থির করতে হবে তার দিশা তিনি আর পাচ্ছেন না। এখনো ভাঙা রেকর্ডের মতো নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে যাচ্ছেন। কার কাছে এই দাবি? শেখ হাসিনার কাছে। শেখ হাসিনা কে? গায়ের জোরে মতা দখল করে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার মতার ন্যায্যতা কী? একদমই নাই। বল প্রয়োগের মতা ছাড়া। সারা দুনিয়ার চোখে বাংলাদেশের মতাসীন সরকার বে-আইনি ও অবৈধ সরকার।

আন্দোলনের এই বিশাল সাফল্যকে একদমই আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়া উল্টা জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার ইঙ্গিতই যেন দিলেন। শেখ হাসিনা তার দুশমনদের ‘জাতীয়তাবাদী’ ও ‘ইসলামি শক্তি’ এই দুইভাবে ভাগ চেয়েছেন। প্রতিপরে নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে অবিশ্বাস্যভাবে সফল হয়ে যাবেন কি? এই আশংকাই এখন দেখা দিয়েছে।

আসলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স, কিম্বা মার্কিন সিনেট কী বলল আর না বলল তাতে কী আসে-যায়! ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের লড়াই ন্যায়সঙ্গত কি না সেই গোড়ার প্রশ্নে স্বচ্ছ থাকা। যদি তা-ই হয় তাহলে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে কে কী সিদ্ধান্ত নিলো, সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ায় ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক জনগণের সমর্থন আদায় করা। দুনিয়ায় কেউই এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করে না। অতএব বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করাটাই প্রধান কাজ। আন্দোলনের ধরন হিসেবে সহিংসতা ও সশস্ত্রতার ভালমন্দ নীতিবাগিশতা দিয়ে ঠিক হয় না। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো গণতন্ত্রের নামে বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে বিরোধী পকে সহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামে প্রকাশ্যেই উসকে দিচ্ছে। গাদ্দাফির পতন কিভাবে ঘটানো হোল, আমরা সে ঘটনা বিচার করে দেখতে পারি, সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য যুদ্ধ চলছে। প্রয়োজনে বিরোধী দলকে মতাসীনদের বিরুদ্ধে উসকে দিতে পাশ্চাত্য কুণ্ঠা বোধ করে না। বরং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। আকাশ থেকে বোমা মেরে তাদের অপছন্দের শাসককে হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করে না। অতএব বাংলাদেশে পাশ্চাত্য আন্দোলনের সহিংস ধরন নিয়ে উদ্বিগ্ন, এটা ডাহা মিথ্যা কথা। তাদের উৎকণ্ঠা অন্যত্র। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শক্তিমান হয়ে উঠুক এটা তারা চায় না। তারা পাশ্চাত্যের দিক থেকে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি অবস্থান। ইউরোপের এই স্বাভাবিক অবস্থানকে প্রতিপ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে। তুলুক।
কিন্তু বিএনপি এতে কাবু হয়ে যাচ্ছে কি? আন্দোলনের বর্তমানপর্যায়ে সেটাই হবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ঘটনা।
(নয়া দিগন্ত, ২৯/০১/২০১৪)

বিডিটুডে.নেট: ইউরোপের পার্লামেন্ট ও বাংলাদেশের রাজনীতি
 
Next Iran, Saudi Arabia will support Sheikh Hasina

OIC keen to work with Hasina
Senior Correspondent, bdnews24.com

Published: 2014-01-29 20:28:57.0 BdST Updated: 2014-01-29 20:28:57.0 BdST


The Organization of Islamic Cooperation (OIC) Secretary General Iyad Ameen Madani has congratulated Prime Minister Sheikh Hasina on her re-election.


Hasina became Prime Minister for the second successive term after Jan 5 elections that her rival Khaleda Zia’s BNP boycotted.

The Ministry of Foreign Affairs on Wednesday said in a message Madani expressed his “deep interest to work closely” with Hasina on issues of “mutual interest and concern”.

OIC+Logo.jpg


The Secretary General hoped that under Hasina’s “wise and far-sighted leadership”, Bangladesh would witness “broad unity and consolidation” in the coming years.

He said OIC stood ready to extend “all possible support” to Bangladesh in its efforts for “political unity, economic progress and social stability”.

OIC keen to work with Hasina -
bdnews24.com


Afghanistan President Hamid Karzai congratulates Sheikh Hasina
January 29, 2014 6:47 pm

Flag-Pins-Afghanistan-Bangladesh.jpg


President of the Islamic Republic of Afghanistan Hamid Karzai congratulated Sheikh Hasina on her reelection as Prime Minister

President Hamid Karzai in his message hoped that the existing friendly relations between Afghanistan and Bangladesh would continue to be strengthened and further consolidated.

Afghanistan President Hamid Karzai congratulates Sheikh Hasina - Click Ittefaq | Click Ittefaq
 
Last edited:
Ugandan president greets Sheikh Hasina
news_1390994692pm.jpg


DHAKA, Wednesday January 29, 2014, ANB24 : Ugandan President Yoweri Kaguta Museveni has congratulated Sheikh Hasina on her reelection as the Prime Minister of Bangladesh.

In a congratulatory message, the Ugandan President mentioned that reelection of Sheikh Hasina in the recent parliamentary polls is a clear testimony of the trust and confidence that the people of Bangladesh have in her able leadership for further socioeconomic transformation of the nation.

Museveni added that Uganda values the warm bilateral relations existing between the two friendly countries and looks forward to working with Prime Minister Sheikh Hasina to take the bilateral ties to a new height.

ASIAN NEWS BROADCAST

Egypt supports Sheikh Hasina

Egyptian PM greets Hasina

Reported by: UNBconnect
Reported on: January 24th, 2014 12:36:42 am

Dhaka, Jan 24 (UNB) – Egyptian Prime Minister Dr Hazem Al Beblawi has congratulated Sheikh Hasina on her assumption of office as Bangladesh Prime Minister for the third time.

In a message to Sheikh Hasina, the Egyptian premier expressed his confidence that the friendship which exists between the two countries will continue to strengthen through future cooperation for the benefit and prosperity of the people of the two countries, said a Foreign Ministry media release on Thursday night.

Egyptian PM greets Hasina | UNB Connect
 
Last edited:
Indonesian President, WTO DG greet PM
Reported on: January 23rd, 2014 05:47:46 pm

indo-hasina-wto.jpg

Dhaka, Jan 23 (UNB) – Indonesian President Susilo Bambang Yudhoyono on Thursday congratulated Sheikh Hasina on her assumption of the office of Bangladesh Prime Minister for the third time.



In a message, the Indonesian President also reaffirmed the intention of the Republic of Indonesia to further develop the constructive and mutually beneficial cooperation in politics, economy and culture between the two countries, says a Foreign Ministry media release.

Director-General of World Trade Organization (WTO) Roberto Azevedo also congratulated Sheikh Hasina for her reelection as the Prime Minister of Bangladesh.

In a message, he thanked Prime Minister Sheikh Hasina for the support of Bangladesh in achieving a successful outcome at the Ninth Ministerial Conference of the WTO in Bali in December 2013.

Azevedo conveyed gratitude of the WTO for Bangladesh’s longstanding commitment to a strong and viable multilateral trading system.

The WTO DG also expressed his desire to continue and strengthen the relationship with Bangladesh.

On Wednesday, Uzbekistan President Islam Karimov and UNCTAD Secretary-General Dr Mukhisa Kituyi congratulated Prime Minister Sheikh Hasina.

Indonesian President, WTO DG greet PM | UNB Connect

World Trade Organization (WTO) greets Hasina

Reported by: UNBconnect
Reported on: January 23rd, 2014 02:37:01 pm

Dhaka, Jan 23 (UNB) – Director-General of World Trade Organization (WTO) Roberto Azevedo congratulated Sheikh Hasina on her assumption of office of Bangladesh Prime Minister for the third time.

In a message, he thanked Prime Minister Sheikh Hasina for the support of Bangladesh in achieving a successful outcome at the Ninth Ministerial Conference of the WTO in Bali in December, 2013.


Azevedo conveyed gratitude of the WTO for Bangladesh’s longstanding commitment to a strong and viable multilateral trading system, according to a media release issued by the Foreign Ministry on Thursday.

The WTO DG also expressed his desire to continue and strengthen the relationship with Bangladesh.

On Wednesday, Uzbekistan President Islam Karimov and UNCTAD Secretary-General Dr Mukhisa Kituyi congratulated Prime Minister Sheikh Hasina.

WTO Director General greets PM | UNB Connect

Uzbekistan greets Sheikh Hasina
risingbd.com
Hasina20140122145727.jpg

Prime minister Sheikh Hasina


Staff Correspondent, DHAKA, Jan 22: Uzbek President Islam Karimov has congratulated Sheikh Hasina on her reelection as the Prime Minister of Bangladesh.


In a congratulatory message on Wednesday, the President hoped that traditional friendship and bonds between the two friendly countries would continue to be strengthened for the benefit of the two countries.

Uzbekistan greets Sheikh Hasina - www.risingbd.com
 
take my idea, ......seems to me it could be 100% successful......I saw proof that there are corrupted armies who take bribe in BA. Bid them at higher price than BAL, then the rest of the task would be carried out by those pawns. And we would get the emancipation from Kutta League.

the question is where that much money come from to buy some top level pawns?
 
Back
Top Bottom