মুক্তিযুদ্ধের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নানা দুঃসাহসিক ঘটনা। এই এপ্রিলেই ফ্রান্সের তুলনে শুরু হয়েছিল প্রবাসের বাঙালিদের প্রথম বিদ্রোহের। পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংগ্রো থেকে পালিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে নানা বিপদ আর অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ান আট বাঙালি নাবিক। শেষ পর্যন্ত কীভাবে তাঁরা পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন, তারই দুঃসাহসিক আখ্যান এটি, লিখেছেন শামীম আমিনুর রহমান
বিদ্রোহের সূচনা
২৬ মার্চ ১৯৭১। ফ্রান্সের ছোট শহর তুলন পোতাশ্রয়ের নৌ-প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কেন্দ্রের সঙ্গেই সমুদ্রের জলে ঈষৎ ভেসে থাকা পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংগ্রো।
সাবমেরিন মেসে বিবিসির সংবাদ শুনছিলেন প্রশিক্ষণরত নাবিকেরা। ফ্রান্সের তুলনে সাবমেরিন ম্যাংগ্রোতে প্রশিক্ষণরত ৫৭ নৌসেনার ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। বেতার তরঙ্গে ভেসে আসছিল ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাতের আঁধারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর বর্বরোচিত, রোমহর্ষক আক্রমণের সংবাদ। পিনপতন নীরবতার মধ্যে বাঙালি নৌসেনারা খবরটা শুনলেন। এবং জানলেন, কীভাবে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানিরা। বিবিসির সংবাদ শেষ হলো। বাঙালি নৌসেনাদের মুখগুলো থমথমে, গম্ভীর। তবে তা স্থায়ী হলো কেবল কিছু সময়ের জন্য। তাঁরা দ্রুতই তাঁদের প্রতিক্রিয়া গোপন করে ফেললেন। পাকিস্তানিদের সামনে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলেন।
ওই দিনই সন্ধ্যায় নৌঘাঁটি-সংলগ্ন ক্যাফেটেরিয়ার লনে গোপন এক বৈঠকে নয়জন বাঙালি সাবমেরিনার ঠিক করে নেন তাঁদের পরবর্তী পরিকল্পনা।
আগেথেকেই ঠিক করা ছিল, ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা পাকিস্তানের সাবমেরিনটি প্রশিক্ষণ শেষে নৌসেনারা নিজেরাই চালিয়ে নিয়ে যাবেন পাকিস্তানে। যাত্রার দিনও ঠিক করা ছিল: ১ এপ্রিল।
বাঙালি নাবিকেরা ঠিক করলেন, ৩১ মার্চ ম্যাংগ্রো সাবমেরিন থেকে যে করেই হোক, পালাতে হবে তাঁদের। সেই পরিকল্পনা সফল করার জন্য প্রতিদিন সবার চোখ এড়িয়ে গোপনে তাঁদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল। প্রতিদিনের কাজ তাঁরা এমনভাবে চালিয়ে গেলেন যেন পাকিস্তানিরা তাঁদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে না পারে। প্রশিক্ষণরত নৌসেনারা পোতাশ্রয়ের যে সৈনিক মেসে থাকতেন, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকারও কিছু প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল বাঙালি নাবিকদের। তাই সুযোগবুঝে বাঙালি নৌসেনারা এক দিন ওই আফ্রিকান বন্ধুদের কাছে তাঁদের পালানোর কথা জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। বাঙালিদের ওপর ঢাকায় যে অত্যাচার চলেছে, সে কথা জেনে বাঙালিদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল। কাজেই সাহায্য করতে রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা।ঠিক হলো, পালিয়ে যাওয়ার দিন তাঁরা পাকিস্তানিদের দৃষ্টি এড়িয়ে বাঙালিদের মালপত্রসমেত ছোট কয়েকটি ব্যাগ তাঁদের গোপন জায়গায় পৌঁছে দেবেন।
সব নৌসেনার পাসপোর্ট সাবমেরিনের একটি লকারে জমা রাখা হয়েছিল। গোপনে লকারের চাবি হস্তগত করে বাঙালি নৌসেনাদের পাসপোর্টগুলো নিজেদের হাতে নিয়ে নিলেন।
পলায়ন পর্ব
৩১ মার্চ সাবমেরিন মেস ছেড়ে যে করেই হোক পালাতে হবে. স্থিরপ্রতিজ্ঞ বাঙালি নাবিকেরা। তীব্র উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটতে লাগল।
সন্ধ্যার মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেলেন সবাই। কেনাকাটা করতে যাওয়ার নাম করে একজন একজন করে বিভিন্ন সময়ে মেস থেকে বেরোতে শুরু করলেন তাঁরা। মেস থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পথ ধরে হেঁটে, ভিন্ন ভিন্ন বাস ধরে ১০০ কিলোমিটার দূরের মারসেলি নামের একটি শহরের রেলস্টেশনে সবাই জড়ো হলেন। বাঙালি নৌসেনাদের ব্যাগগুলো নিয়েও যথাসময়ে হাজির হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার নাবিক বন্ধুরা।
নয় থেকে আট
পরিকল্পনামতো তাঁদের দলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল মোট নয়জনের দেখা গেল রাত ১১টা পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছেন আটজন। একজন অনুপস্থিত। সাবমেরিনের ১৩ বাঙালি নৌসেনার মধ্যে অফিসার শ্রেণীর চারজনকে তাঁরা দলে পাননি। মতের মিল না হওয়ায় এবং তাঁদের পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করায় ঝুঁকি নিতে তাঁদের দ্বিধা ছিল।
স্টেশন থেকে ঠিক ১১টায় একটি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। ১১টা বেজে যাওয়ার পরও বন্ধুটি না আসায় শেষে তাঁরা আটজনেই ট্রেনের একটি কামরা বেছে নিয়ে উঠে পড়লেন। পরে তাঁরা জেনেছিলেন, তাঁদের নবম বন্ধুটি পরিবার ও নানা পিছুটানের কথা ভেবে ওই যাত্রায় শরিক না হয়ে তাঁর কাছে লন্ডনে পালিয়ে যাওয়াটাই বেশি নিরাপদ মনে হয়েছিল।
ফ্রান্স থেকে বিদ্রোহী দলটির পরবর্তী গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা। কারণ, তুলন থেকে সবচেয়ে কাছের শহর হচ্ছে জেনেভা। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তখন ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ডে ঢুকতে কোনো ভিসার দরকার হয় না। এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই তাঁদের জেনেভাকে বেছে নেওয়া।
জানামতে, ট্রেনটি সারা রাত চলার কথা। সকাল আটটায় ট্রেনটি জেনেভা স্টেশনে এসে পৌঁছাল।
ট্রেন থেকে যাত্রীরা নেমে কাস্টম চেকপোস্ট পার হওয়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যাঁর যাঁর পাসপোর্ট দেখিয়ে চেকপোস্ট পেরোতে শুরু করলেন যাত্রীরা। কিন্তু বাঙালি নৌসেনাদের বেলায় এসে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল। তাঁদের আটকে দিয়ে জানানো হলো, ভিসা ছাড়া সুইজারল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন না তাঁরা। তাঁদের পাসপোর্ট জব্দ করে তাঁদের পাশের একটি কক্ষে নিয়ে আটক রাখা হলো। এ সময় বিদ্রোহী নৌসেনারা এই ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন যে, তাঁদের যদি ফ্রান্সের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং ফ্রান্সের পুলিশ যদি আবার তাঁদের পাকিস্তানিদের কাছে হস্তান্তর করে, তাহলে তাঁদের ভাগ্যে কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে?
টানা দুই ঘণ্টা আটকে রাখার পর এক পুলিশ অফিসার এসে তাঁদের জানাল, পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তবে ফ্রান্সেই ফিরে যেতে হবে তাঁদের। ফ্রান্সে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন তাঁরা। কিন্তু এতেই দমে গেলেন না। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এই যুদ্ধে তাঁদের যোগ দিতেই হবে।
জেনেভা অভিযান ব্যর্থ
জেনেভা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলে দলটির উপলদ্ধি হয়: প্যারিসে থাকা তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। পাকিস্থান কর্তৃপক্ষ চুপচাপ বসে থাকবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব ফ্রান্স ছাড়তে হবে তাঁদের। তার আগে ঠিক হলো, আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ফ্রান্সের লিয়নে চলে যাবেন তাঁরা। লিয়ন বড় শহর, সেখানে ফ্রান্স ছাড়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের জন্য আত্মগোপন করে থাকা সহজ হবে।
লিয়নে পৌঁছেই সন্ধ্যায় এক গলির ভেতর পাশাপাশি দুটি হোটেল খুঁজে বের করা হল। দুই হোটেলে চারজন করে ভাগ হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এ সময়ে তাঁরা খবর পেলেন, লিয়ন শহরের হোটেলগুলোতে এরইমধ্যে ফরাসি গোয়েন্দা ও পুলিশ তাঁদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে। হোটেলে হোটেলে গিয়ে বোর্ডারদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করছে তারা। এ রকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতে হঠাৎ অন্ধকারে আলোর দেখা পাওয়ার মতো তাঁদের দলনেতা গাজী মো. রহমতউল্লা ট্যুরিস্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলেন, স্পেন সরকার তিন মাসের জন্য কেবল পাকিস্তানিদের সে দেশে প্রবেশে কোনো ভিসার প্রয়োজন হবে নাএমন একটা ঘোষণা দিয়েছে।
পরদিন সকালেই নৌসেনার দলটি স্পেনের পোর্টবো রেলস্টেশনে এসে পৌঁছাল। এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা ইমিগ্রেশনের বাধাও পেরিয়ে এলেন। এর পরই তাঁরা বার্সেলোনার ট্রেন ধরলেন। বার্সেলোনায় পৌঁছে তাঁদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল নিরাপদ হোটেলের খোঁজ বের করা। খুব বড় হোটেল তাঁরা এড়িয়ে গেলেন। শেষে এক গলির ভেতর অখ্যাত এক হোটেল পেয়ে আটজনই উঠে পড়লেন। এখানেই স্থির হলো সবচেয়ে নিরাপদ আর কার্যকর উপায় হবে, ভারতীয় দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা।
এদিকে, ইউরোপে পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে আটজন বাঙালি বিদ্রোহ করে পালিয়েছে এ খবর চাউর হয়ে গেছে। এ খবর পেয়ে ভারত সরকার তাদের দূতাবাসগুলোকে গোপনে জানিয়ে দেয় যে তারা যেন এই পলাতক দলটির খোঁজ নেয় এবং প্রয়োজনে তাদের আশ্রয় দেয়। তবে এ সময় প্রায় প্রতিটি সম্ভাব্য শহরেই ইউরোপীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা এবং ভারতীয় দূতাবাস ও তাদের গোয়েন্দারাও হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে এই দলটিকে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে দিনের পুরো সময় বিদ্রোহী দলটি হোটেলেই কাটাতে লাগলেন। এরমধ্যে একদিন বার্সেলোনায় অবস্থিত ভারতীয় কনস্যুলেটের ছোট অফিসটায় গেলে; সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তা, যিনি একজন স্প্যানিশ, বাঙালি দলটিকে দ্রুত মাদ্রিদে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিলেন। পরামর্শ মতো দলটি পরের দিন মাদ্রিদে পৌঁছে একটি হোটেলে অবস্থান নেয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সন্দেহ হল, স্প্যানিশ পুলিশ তাঁদের খোঁজে হোটেলে হোটেলে হানা দিচ্ছে। হোটেলের মালিকও তাঁদের জানালেন যে পাকিস্তান দূতাবাসের অনুরোধেই স্প্যানিশ পুলিশ তাঁদের খোঁজ করছে। তীব্র উৎকণ্ঠায় পড়ে গেলেন দলের সবাই।
নতুন গন্তব্য
এখন কিছুতেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা পড়া চলবে না তাঁদের। দ্রুত ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছাতে হবে তাঁদের। রাত ভোর হতেই পরদিন ভারতীয় দূতাবাসে হাজির হয়ে চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স মি. বেদির সঙ্গে দেখা করলেন তাঁরা। মি. বেদি তাঁদের পরিচয় ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের কথা শুনে যা বলেছিলেন, তা ওই দলটিকে মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় করে দেয়। তিনি সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমরা তো আরও আগেই আপনাদের দেখা পাব ভেবেছিলাম। এত দেরি হলো কেন? আপনারা চাইলে তো প্যারিসেই আমাদের দূতাবাসে আশ্রয় নিতে পারতেন। এটা শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ নীরব ও স্থির হয়ে থাকল আট নৌসেনার দলটি। এত সহজেই তাঁরা আশ্রয় পেয়ে যাবে, এটা ছিল তাঁদের কল্পনারও অতীত।
দুই দিন পর মি. বেদি তাঁদের হোটেলে এসে জানালেন, ভারত সরকার তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে এবং দ্রুত তাঁদের জন্য ইমার্জেন্সি পাসপোর্টের ব্যবস্থা হচ্ছে।
পাসপোর্ট হস্তান্তর হওয়ার পরের দিনই বাঙালি দলটিকে রোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁরা ভারতের দিল্লিতে যাবে।
শেষ অঙ্ক
ভারত বিদ্রোহী নৌসেনাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংগ্রো থেকে এই খবর প্রচার হলে সারা বিশ্বে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ফলে রোম বিমানবন্দরে সাংবাদিকেরা বাঙালি নৌসেনাদের সাক্ষাৎকার নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
একজন বাঙালি নাবিক বলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য ভারত হয়ে বাংলাদেশে যাবেন। এ সময় পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে বাঙালি দলটিকে পাকিস্তানি নাগরিক দাবি করে তাঁদের জোরপূর্বক সরিয়ে নিজেদের জিম্মায় নেওয়ার চেষ্টা করলে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে ভারতীয় দূতাবাস কর্মকর্তাদের দ্রুত হস্তক্ষেপে ও পুলিশের বাধায় পাকিস্তানিদের সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
কিন্তু নতুন বিপত্তি ঘটে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের যে বিমানটি রোম হয়ে বোম্বে যাওয়ার কথা, সেটিতে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিলম্বে উড়বে জানানো হলে পরিস্থিতি আরেক দফা নাটকীয় মোড় নেয়। পাকিস্তান দূতাবাস এবার বাঙালিদের আটক করতে ইতালি কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়। পাকিস্তান দূতাবাস অভিযোগ করে, ভারত জোর করে তাদের নাগরিকদের দিল্লি নিয়ে যাচ্ছে। এ রকম ঘোলাটে পরিস্থিতি দেখে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের বোম্বের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে, এ রকম সুইস এয়ারের একটি বিমানে দ্রুত আটজনের জন্য টিকিট কিনে বিমানে চড়িয়ে দেয়। তার আগে তাঁদের ভিআইপি লাউঞ্জের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে বিমানে চড়ানো হয়।
৩১ মার্চ এই আট বাঙালি নৌসেনা সব বাধা ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সেদিন যে অনিশ্চিত, ক্লান্তিকর, নির্মম এক যাত্রাপথে পা বাড়িয়েছিলেন, তা শুধু দেশের প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য প্রেমের কারণে। সেই যাত্রার যবনিকা ঘটেছিল ৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বোম্বে বিমানবন্দরের মাটিতে পা রাখার মধ্য দিয়ে। এই দলটি ছিল প্রবাসে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন প্রথম বিদ্রোহী বাঙালি দল। তারা যে সংগ্রামের পথটি বেছে নিয়েছিল, ৮ এপ্রিলের ওই দিন ছিল সেই পথের প্রথম অঙ্কের সমাপ্তি।
এর পরও তাঁদের আরও অনেক নির্মম কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁদের নিয়েই পরবর্তীতে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের নৌকমান্ডোর দল। বুকে লিমপেট মাইন বেঁধে রাতের অন্ধকারে কনকনে শীতল জলে সাঁতার দিয়ে তাঁরা অসংখ্যবার এগিয়ে গেছেন ভাসমান শত্রুর জাহাজের দিকে।
এ রকমই এক দুঃসাহসিক অভিযানে ওই দলের আটজনের একজন রকিব মিয়া অক্টোবরে শত্রুর জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান।
অতঃপর, পিএনএস ম্যাংগ্রো
ওদিকে ১ এপ্রিল পিএনএস ম্যাংগ্রো তুলন নৌবন্দর ছেড়ে যায়। তবে সাবমেরিন থেকে যে নয়জন বাঙালি নৌসেনা পালিয়ে গেছে, এ ব্যাপারটি প্রথম দিকে পুরো চেপে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে স্পেনের একটি বন্দরে সাবমেরিনটি ভেড়ার পর খবরটা ফাঁস হয়ে যায়। ভীষণ হইচই পড়ে যায় চারদিকে। ইউরোপ তথা ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও স্পেনের গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা ধারণা করে, বাঙালি বিদ্রোহী সেনারা ফ্রান্সের সীমান্ত পার হয়ে এসব দেশের যেকোনোটাতে ঢুকে পড়তে পারে। সে সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা ও দূতাবাস এবং ভারতীয় দূতাবাসের লোকজনও হন্যে হয়ে এই বিদ্রোহী দলটিকে খুঁজতে শুরু করে।