Banglar Bir
SENIOR MEMBER
- Joined
- Mar 19, 2006
- Messages
- 7,805
- Reaction score
- -3
- Country
- Location
বাংলা ভাগে ভাষা ও সাহিত্যের রাজনীতি পর্ব ৭
08/05/2016 মূলধারা বাংলাদেশ
লিখেছেনঃ নুরুল কবির, সম্পাদক নিউ এইজ
আগের পর্বঃ পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব ৩ পর্ব ৪ পর্ব ৫ পর্ব ৬
হিন্দু রাজনৈতিক পুনঃর্জাগরণের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক সক্রিয়তা
যখন রাজা রামমোহন রায়ের ‘ব্রাহ্মবাদ’ এবং তত্ত্ববোধিনী গ্রুপের সহযোগী সাহিত্যনির্ভর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড হিন্দুদের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ ঠেকাতে বেশ ভালভাবে সফল এবং একই সাথে বাংলা আধুনিক গদ্যের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হল, তখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) সাহিত্যকর্ম একদিকে বাংলায় হিন্দু পূনঃর্জাগরণে রাজনৈতিক আন্দোলন জাগিয়ে তুললো এবং অন্যদিকে, বাংলা গদ্যের উন্নয়নে একটি গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এল।
বাংলা গদ্যের উন্নয়নে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা যেখানে শেষ করে গিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র সেখান থেকেই শুরু করলেন। সুকুমার সেন যথাযোগ্যভাবেই বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের পথ ধরেই বঙ্কিম তার বাংলা গদ্যের উন্নয়নের যাত্রা শুরু করেন।’ যার অর্থ দাঁড়ায় অন্যান্য বিষয়াদির সাথে প্রচুর তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ, যুক্ত শব্দ এবং সংস্কৃত ব্যাকরণরীতির ব্যবহার করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রও। [সুকুমার সেন, বাঙলা সাহিত্যে গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭৭]
ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তার দীর্ঘ সময়ের সাধনায় বঙ্কিম নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন। তার এই ধারায় তিনি তৎসম (সংস্কৃত শব্দ) ও তদভব (সংস্কৃত থেকে উৎসারিত শব্দ) শব্দের ব্যবহার এবং কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকার মৌখিক ভাষায় কমে যাওয়া যৌগিক শব্দ ও বাক্যের ব্যবহারে ভারসাম্য আনেন। [সুকুমার সেন, প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৯]
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের ধারায় বঙ্কিমের অন্যতম অবদান হচ্ছে ইংরেজি ‘ফ্যাশনে’ সফলভাবে বাংলা উপন্যাস লেখা। তিনি বাংলাকে, বিশেষ করে বাংলা গদ্যরীতিকে বিশেষ একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সময়ে বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বঙ্কিম হচ্ছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৬ সালে ঠাকুর কাব্যিক ভাষায় বঙ্কিমের প্রশংসা করে সঠিকভাবেই বলেছিলেন,
‘বাংলা ভাষায় পৃথিবীতে যতদিন থাকবে তিনিও (বঙ্কিম) ততদিন বেঁচে থাকবেন। কারণ তার কর্মে ভবিষ্যত যুগের সাহিত্যের জন্য মৌলিক উপাদান বিদ্যমান ছিল। তিনি একই সাথে অন্ধকার রাতের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মশাল ধরিয়ে দিয়েছিলেন, আবার ভাষার পরিবর্তন মেনে না নেয়ার অযোগ্যতাটিও দূর করেছিলেন’ [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রসমগ্র, ভলিউম ১৮, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা]।
ঠাকুর ১৯৩৬ সালে তার ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ কবিতাটি লিখেন। উপরে উদ্ধৃতিটি সেই কবিতার কয়েকটি লাইনের ভাবানুবাদ। বঙ্কিমের প্রশংসায় কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), যিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক খ্যাতিমান, একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
‘রবীন্দ্রনাথ যদি আমাদের ভারতবর্ষের আকাশে দুর্ভাগ্যের অন্ধকারের মধ্যে সূর্য হয়ে আভির্ভূত হয়ে থাকেন, তাহলে বঙ্কিম হচ্ছেন ভোরের আলোক রেখা’ [কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল রচনাবলী, ভলিউম ১১, নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সংকলন, বাংলা একাডেমি, ২০১২, ২৯১]।
আহমদ ছফা বলেছেন যে, ‘বঙ্কিম হচ্ছেন বাঙলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার হাত ধরেই বাংলা গদ্য একটি পরিণত রূপ লাভ করে এবং বিভিন্ন ধরনের মানবীয় আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করার মতো গতিশীল ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। [আহমদ ছফা, বাংলার সাহিত্যদর্শ, মোর্শেদ সাইফুল হাসান সংকলন, ‘আহমদ ছফা: নির্বাচিত প্রবন্ধ’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০০২, পৃষ্ঠা ৮৪]
বঙ্কিমের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উন্নয়নে কাজে আসেনি বরং, সাধারণভাবে ভারতের রাজনীতি এবং বিশেষভাবে বাঙলার রাজনীতির অনাগত ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক উন্নতির দার্শনিক ভিত্তি (Philosophical Direction) ছিল সাম্প্রদায়িক, যা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টিতে সহায়তা করে। বঙ্কিমের সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব এখনো ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
এ ক্ষেত্রে এটি বলাই যায় যে, বঙ্কিম একই সাথে সম্মানিত ছিলেন এবং কাজগুলো আদর্শিক ছিল। ২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাঙলার ‘উপনিবেশবিরোধী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী আন্দোলন’ এর সাথে জড়িতদের কাছে তিনি যেমন প্রেরণা ছিলেন, তেমনি বর্তমানেও উত্তর ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে সমানভাবে সম্মানিত।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকিকরণ প্রক্রিয়ায় বঙ্কিম এটা বুঝতে পারেন যে, চিন্তা এবং অনুভূতিকে স্পষ্ট এবং জঠিলতাহীনভাবে প্রকাশ করা খুবই জরুরি। আবার সেটা ‘স্পষ্ট এবং সম্পূর্ণভাবে’ বাংলায় প্রকাশের জন্য শব্দভান্ডার বৃদ্ধির বিষয়টিও অনুধাবন করেন। ফলে তিনি বিভিন্ন বিদেশী ভাষা থেকে উদারভাবে শব্দ গ্রহণের ‘পক্ষে’ ছিলেন। তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাঙলা ভাষা’তে ১৮৭৮ সালে বঙ্কিম লিখেছেন, ‘যা বলতে হবে স্পষ্টভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে বলতে হবে। স্পষ্ট ও সম্পূর্ণভাবে বলার সুবিধার্থে ইংরেজি, ফার্সি, আরবী, সংস্কৃত, রাস্টিক, সিলভান যে কোনো ভাষার শব্দকে গ্রহণ করুন যদি সেগুলো অশালীন না হয়। [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বাঙলা ভাষা: লিখিবার ভাষা, বঙ্কিম রচনাবলী: সাহিত্য সমগ্র, প্রথম তুলি-কালাম সংকলন, তুলি-কালাম, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৩৭৩]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪)
এখানে বঙ্কিম যেভাবে ‘যে কোনো ভাষার শব্দ’ গ্রহণের কথা বলেছেন তাতে তাকে উদার মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এমন ছিলেন না। সংস্কৃতের প্রতি তার সবিশেষ পছন্দ ছিল। একই প্রবন্ধে বঙ্কিম লিখেছেন, ‘বাংলা এখনো একটি অনুন্নত ভাষা। ফলে এখন অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বদা শব্দ দিয়ে সহায়তা করা সংস্কৃত থেকেই ধার নেয়া উচিত। প্রথমত, সংস্কৃত হচ্ছে ‘শব্দ ধার দেয়া’র মতো সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা, যেটি যে কাউকে তার চাওয়া মতো যে কোনো ধরনের শব্দ ধার দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত শব্দমালার সাথেই বাংলাকে বেশি মানায়, কারণ এর (বাংলার) মেরুদন্ড, শিরা-উপশিরা সংস্কৃত দিয়েই তৈরি।’ [প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭২]। এখানে এটা বলে রাখা প্রাসঙ্গিক যে, ভাষাবিদরা, এমনকি বাঙালী ভাষাবিদরাও বাংলা ভাষার উৎপত্তির (Philological root ) ইতিহাসের ব্যাপারে একমত নন।
শেষের উদ্ধৃতিটিতে বিদেশী ভাষা থেকে শব্দ নেয়ার বিরোধীতা করা বঙ্কিমের যে রূপ দেখা যাচ্ছে তা আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তৎকালীন মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে সবেচেয় বেশি সংস্কৃত প্রভাবিত লেখক মীর মশাররফ হোসেনে ভাষাগত ব্যবহারের ব্যাপারে বঙ্কিমের একটি প্রশংসা থেকে। ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন প্রকাশিত জমিদার দর্পন বইটির গদ্যরীতির প্রশংসা করে বঙ্কিম লিখেছেন,
‘এতে মুসলমানি বাংলার কোন ছাপ নেই। এবং এই মুসলিম লেখকের বাংলা ভাষা অনেক হিন্দু লেখকের ভাষার চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ।’ [সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ বইয়ে বঙ্কিমের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। ইউপিএল, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ২৮]।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালীন মুসলিম গদ্য লেখকরা মুসলিম সমাজের সাধারণ্যে শত শত বছর ধরে বহুল ব্যবহৃত আরবী-ফার্সি শব্দাবলীকে তাদের সাহিত্যে বেশ ব্যবহার করতেন। কিন্তু বঙ্কিমের কাছে এই ধরনের ‘মুসলমানি’ কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকা বাংলা ভাষাটি ‘বেশি বিশুদ্ধ’ । বুঝাই যাচ্ছে, ভাষাবিজ্ঞানের মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দ ও ভাষার ‘বিশুদ্ধতা’ ও ‘অশুদ্ধতা’র ধারণাটি যে পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ, তা বঙ্কিম মনে করতেন না।
বাঙালী ভাষাতত্ত্ববিদ শ্যামাচরণ গঙ্গপাধ্যায়/গাঙ্গুলী ১৮৮৭ সালে তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশুদ্ধতার ধারণাটি মারাত্মকভাবে অপরিপক্ক এটি মূলত এক ধরনের সংকীর্ণতা থেকে উৎসারিত। বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে অবাধে চলাফেরা-মেলামেশা হওয়ার ফলে লেনদেনের (ভাষাগত) বিষয় অবশ্যই থাকবে। যখন মানুষ তাদের রক্তকেই ‘বিশুদ্ধ’ রাখতে পারে না, তখন ভাষাকে ‘বিশুদ্ধ’ রাখার চিন্তা করার চেয়ে অদ্ভুত কিছু কি আছে? মানুষের কোনো ভাষাই কখনো পুরোপুরি বিশুদ্ধ ছিল না। দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশী বিষয়াদির আগমন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে।… ফলে মানুষের ভাষা অবশ্যই মিশ্রিত, অবিশুদ্ধ, বহুপক্ষীয় হবেই। ‘গরীব’ বা ‘দাগ’ এর মতো শব্দগুলোকে তাদের বিদেশী সম্পৃক্ততার কারণে বই থেকে বাদ দেয়া হবে সবচেয়ে অযৌক্তিক কাজ। বর্তমানে ব্যবহৃত আরবী এবং ফার্সি মূলের শব্দগুলো আমরা যারা বাঙালী হিন্দু তাদেরকে বাঙালী মুসলমানদের সাথে, সারা ভারতের মুসলমানদের সাথে এমনকি আরবও পারস্যের মানুষদের সাথেও সম্পর্কযুক্ত করছে। শুধু সংস্কৃত ভাষায় কথা বলা আমাদের পূর্বপুরুষদের একটু ‘নিকটবর্তী’ হওয়ার আশায়আমাদের দেশের একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের সাথে, যাদের আমাদের ‘সহবাহসও হয়েছে’ এমন প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের সম্পর্কের সুতোটি নষ্ট করে দেয়া কি খুব বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে? [শ্যামাচরণ গঙ্গপাধ্যায়, ‘বেঙ্গলী স্পোকেন এন্ড রিটেন’, ই. লেথব্রিজ কলকাতা রিভিউ, ভলিউম এলএক্সভি, একাডেমি পত্রিকা, তৃতীয় ইস্যু, পশ্চিম বাংলা একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, মে ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ২২-২৩]
এখনো বহু মানুষ তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য নিজেদের দেশে বেঁচে থাকা সহ-নাগরিকদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শ্যামচরণ গঙ্গপাধ্যায় এ বিষয়ে হিন্দুদের আচরণের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
‘মৃত পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্ক (আত্মিক) তৈরির চেয়ে বেঁচে থাকা আশপাশে মানুষের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিই মানুষের সুখ শান্তি বৃদ্ধিতে বেশি ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু অনেক সময় মানুষ এসব বিষয় বিবেচনায় যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়। বাঙালী হিন্দুরা যে অনুভূতির দ্বারা তাড়িত হয়ে সংস্কৃতের দিকে ঝুঁকে তা বুঝা খুবই সহজ। ভারতের গৌরবময় দিনগুলির সাথে সংস্কৃত জড়িত। আর আরবী ও ফার্সির প্রভাবের দিনগুলি হচ্ছে এর (ভারতের) পরাজয়, অপমান ও শিকলবদ্ধ হওয়ার দিন। ফলে স্ফুটনোন্মুখ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই আরবী-ফার্সি শব্দকে তাদের দাসত্বেও শিকল হিসেবে মনে করে সেগুলোকে পরিহার করে চলে’ [প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ২৩]।
শ্যামচরণ গঙ্গপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তির ব্যাপারে বঙ্কিম সচেতন ছিলেন। কিন্তু তার ‘স্ফুটনোন্মুখ দেশপ্রেম’ তাকে শুধু আরবী-ফার্সি থেকে আগত ‘মুসলমানি’ শব্দ গ্রহণ থেকে বিরতই রাখেনি, বরং বেঙ্গলের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় এখানকার হিন্দুদের থেকে মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্ন করার বিনিময়ে হলেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে জাগিয়ে তোলার পেছনে তার মেধাকে খরচ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। [বঙ্কিম নিজে শ্যামচরণের যুক্তির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এটা বঙ্কিমের বিখ্যাত ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে শ্যামচরণকে উদ্ধৃত করা থেকে স্পষ্ট হয়। দেখুন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, ভাঙালা ভাষা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭১]।
বঙ্কিমের হিন্দুত্ব-প্রভাবিত গদ্য বেশ ফল দিতে শুরু করে। বিশেষ করে তার তথা কথিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বেঙ্গলকে ধর্মীয় দিক থেকে ভাগ করতে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্কিম তার আধুনিক উপন্যাসের সাহিত্যিক রূপকে ব্যবহার করে মুসলমানদের বাদ দিয়ে একটি হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্র গঠনে তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাকে তুলে ধরেন। এটা করতে গিয়ে ভারতে মুসলমানদের শাসনকে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করতে হয়েছে। একই সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশকদের নানা নিপীড়নকে এড়িয়ে গিয়ে তাদের মহিমান্বিত করে তুলো এবং এখানকার মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খারাপভাবে চিত্রিত করতে হয়েছে। তিনি তার কথিত ‘ইতিহাসনির্ভর’ উপন্যাস যেমন, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, সিতারাম এবং রাজ সিঙ্গা’য় এর সবই করেছেন।
উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে ভারতে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের ‘চেতনাপুরুষে’ পরিণত হন বঙ্কিম। তার আনন্দমঠ হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতেহারে হিসেবে গৃহিত হয়। বঙ্কিম যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে মুসলমানদের কোন সম্মানজনক অবস্থান ছিল না বললেই চলে।
‘আনন্দমঠ’কে অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয়াংশে বাঙলার উপনিবেশবিরোধী কৃষকসমাজের বিদ্রোহের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে লেখা উপন্যাস বলে দাবি করা হয়ে থাকে। ইংরেজদের উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে বহু সংখ্যক কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাঙলা এবং বিহারে কলকাতাভিত্তিক ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিরুদ্ধে যে ক’টি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে সেগুলো ইতিহাসে সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বলে খ্যাত। বঙ্কিম তার আনন্দমঠ এইসব বিদ্রোহকে উপজীব্য করে রচনা করেন, যেগুলোর আয়োজনে এবং অংশগ্রহণে হিন্দু সন্যাসী ও মুসলমান ফকির উভয়পক্ষ ছিল।
কিন্তু উপন্যাসে এসব বিদ্রোহ থেকে মুসলমান ফকিরদের অংশগ্রহণ ও ত্যাগকে বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু সন্যাসীদের একক আন্দোলন হিসেবে দেখিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি বঙ্কিম, বরং এগুলোকে তিনি ‘প্রধানত বাঙলার নিপীড়ক মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ হিসেবে দেখিয়েছেন। ইতিহাস বলছে, ফকির ও সন্যাসীদের বিদ্রোহের সময়ে মুসলমানরা বাঙলা শাসন করছিল না। এমনকি বঙ্কিমও তার উপন্যাসের দুই জায়গায় ওয়ারেন হেস্টিংসকে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, উপন্যাস সমগ্র, খান ব্রাদার্স এন্ড কো., ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৬১, এবং ৭৮৫। ওয়ারেন হেস্টিংস বাঙলার প্রথম গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৭৭২ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত।
‘শত্রুসেনা’, যারা আনন্দমঠের বিদ্রোহী বা সন্তানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিল তাদেরকে উপন্যাসে ‘তৈলাঙ্গি, মুসলিম, হিন্দুস্তানী এবং ইউরোপিয়ান’ এসব পরিচয়ে তুলে ধরা হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন থমাস নামের এক আইরিশ ক্যাপ্টেন। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭৭] কিন্তু এই ‘শত্রুসেনা’দের বিরুদ্ধে যখন হিন্দু বিদ্রোহীরা পাল্টা লড়াই করতে নামে তখন তাদের স্লোগান ছিল ‘মার মার নেড়ে মার।’ (নেড়ে বলতে মুসলমানদেরকে বুঝানো হতো) [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭২]।
বঙ্কিম তার আনন্দমঠ’সহ সবগুলো ‘ইতিহাসনির্ভর’ উপন্যাসে মুসলমানদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে নানা কটুক্তিমূলক শব্দ যেমন- নেড়ে, যবন, ম্লেচ্ছ- ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি মুসলিমদেরকে হত্যা করার সময় অনেক হিন্দু বিদ্রোহীকে পাওয়া গেছে যারা খুব আগ্রহভরে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ভাই, এমন দিন কি আসবে না যখন আমরা মসজিদের ধ্বংসস্তুপের ওপর রাধামাধবের মন্দির নির্মাণ করতে পারবো?’ [প্রাগুক্ত]
এসবের মধ্যে হিন্দু বিদ্রোহীদের এক নেতা ভবনানন্দকে দেখা যায় তিনি ‘শত্রুসেনা’দের ইউরোপিয়ান ক্যাপ্টেন থমাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলছেন, ‘মি. ক্যাপ্টেন, আমরা আপনাকে হত্যা করবো না। ইংরেজরা আমাদের শত্রু নয়। আপনি এখানে কেন মুসলমানদের সাহায্য করতে এসেছেন? আসুন, আপনাকে আমরা জীবনের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। শুধু কিছু সময় আপনি যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকবেন। ইংরেজরা বিজয়ী হোক। আমরা আপনাদের বন্ধু। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭৬]।
[উৎসঃ নুরুল কবির এর লেখা Colonialism, politics of language and partition of Bengal, ৩৫ পর্বের ধারাবাহিক অনুবাদ।লেখক এই সিরিজটি তার সম্পাদিত ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকায় ২০১৩ সালে প্রকাশ করেন। প্রথম ১১ পর্বে তিনি বাংলা ভাগের রাজনৈতিক কারণগুলো আলোচনা করেছেন।সেই ১১ পর্ব নিয়ে মূলধারা বাংলাদেশ একটি ই-বই প্রকাশ করেছে। সেই বই এবং পর্ব আকারে লেখা পেতে লিংকে ক্লিক করুন ]
পরের পর্ব-পর্ব ৮
প্রাসঙ্গিক পোষ্টঃ
বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা ৩
মুসলমান বাংলা লিখিতে জানে না– মহাকবি কায়কোবাদ এর সে সময়ের অভিজ্ঞতা
ঢাকার প্রমিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক উপনিবেশের প্রভাব
সাম্প্রদায়িকতাঃমুক্ত নন রবীন্দ্রনাথও
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রদায়িক চেহারা
http://www.muldharabd.com/?p=816
২০১৭ সাল-৩৩ তম সপ্তাহঃ মুক্তি ও শোকের আগষ্ট, ঘটনাবহুল ৪৭ এবং ৭৫
মূলধারা বাংলাদেশ· SUNDAY, 20 AUGUST 2017
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও কুখ্যাত কোলকাতা হত্যাযজ্ঞ
কলকাতা দাঙ্গার দায়ভারঃ মুসলিম লীগের কোন প্রস্তুতিই ছিলনা
কলকাতা দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াঃ নোয়াখালী দাঙ্গা ও কলকাতা কেন্দ্রিক প্রোপ্যাগান্ডা মিশন
পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠা কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম-শেখ মুজিবুর রহমান
১৯০ বছরের গোলামী থেকে মুক্তির দিন আজান দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল পূর্ববাংলার অধিবাসীরা
শিশুরাষ্ট্র হিসেবে পূর্ববঙ্গের যাত্রা শুরু
'আর পাকিস্তানে যেতে চাই না': বিহার থেকে আসা উর্দুভাষীদের অবস্থা
সিলেট আসল বাংলাদেশে কিন্তু করিমগঞ্জ চলে গেল ভারতে!
দেশভাগে উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না
Partiton 1947: Indian Muslims become second class citizen: Kuldip Nayar
আগষ্ট ১৯৭৫
বঙ্গবন্ধুর মত জনপ্রিয় নেতার এমন পরিণতি কেন হলো?
আওয়ামীলীগের একটা অংশ পরিবর্তন চাচ্ছিলো, এবং ১৫ আগস্টের ঘটনায় অনেকেই খুশি হয়েছে-মহিউদ্দিন আহমদ
চাটুকার ও সুযোগসন্ধানীদের ক্ষপ্পরে পড়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান
মুজিব পুজার সুত্রপাত
১৫ আগষ্টের প্রেক্ষাপট: দেশের পরিস্থিতি যা ছিল
আগষ্ট হত্যাকান্ড ও 'এক বাক্সে সকল ডিম না রাখার' ভারতীয় নীতি
আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পতন চেয়েছি ও রক্তাত্ব বিরোধিতা করেছি-জাসদ
'শেখ মুজিবের লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া উচিত ছিল'-কর্ণেল তাহের !
'ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল, তিনি পারলেন না'-অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
বিবিধ
ষোড়শ সংশোধনী বাংলাদেশকে 'আওয়ামী লীগের প্রজাতন্ত্রে' পরিণত করতে চেয়েছিল-বদরুদ্দিন উমর
খিলাফত আন্দোলন থেকেই বাঙ্গালী মুসলমানের রাজনৈতিক নেতাদের উঠে আসা
'ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল, তিনি পারলেন না'-অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
প্রাসঙ্গিক আগের সপ্তাহের পোষ্টের লিংকঃ
২০১৭ সাল-৩২ তম সপ্তাহঃ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ও দেশভাগ
08/05/2016 মূলধারা বাংলাদেশ
লিখেছেনঃ নুরুল কবির, সম্পাদক নিউ এইজ
আগের পর্বঃ পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব ৩ পর্ব ৪ পর্ব ৫ পর্ব ৬
হিন্দু রাজনৈতিক পুনঃর্জাগরণের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক সক্রিয়তা
যখন রাজা রামমোহন রায়ের ‘ব্রাহ্মবাদ’ এবং তত্ত্ববোধিনী গ্রুপের সহযোগী সাহিত্যনির্ভর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড হিন্দুদের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ ঠেকাতে বেশ ভালভাবে সফল এবং একই সাথে বাংলা আধুনিক গদ্যের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হল, তখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) সাহিত্যকর্ম একদিকে বাংলায় হিন্দু পূনঃর্জাগরণে রাজনৈতিক আন্দোলন জাগিয়ে তুললো এবং অন্যদিকে, বাংলা গদ্যের উন্নয়নে একটি গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এল।
বাংলা গদ্যের উন্নয়নে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা যেখানে শেষ করে গিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র সেখান থেকেই শুরু করলেন। সুকুমার সেন যথাযোগ্যভাবেই বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের পথ ধরেই বঙ্কিম তার বাংলা গদ্যের উন্নয়নের যাত্রা শুরু করেন।’ যার অর্থ দাঁড়ায় অন্যান্য বিষয়াদির সাথে প্রচুর তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ, যুক্ত শব্দ এবং সংস্কৃত ব্যাকরণরীতির ব্যবহার করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রও। [সুকুমার সেন, বাঙলা সাহিত্যে গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭৭]
ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তার দীর্ঘ সময়ের সাধনায় বঙ্কিম নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন। তার এই ধারায় তিনি তৎসম (সংস্কৃত শব্দ) ও তদভব (সংস্কৃত থেকে উৎসারিত শব্দ) শব্দের ব্যবহার এবং কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকার মৌখিক ভাষায় কমে যাওয়া যৌগিক শব্দ ও বাক্যের ব্যবহারে ভারসাম্য আনেন। [সুকুমার সেন, প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৯]
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের ধারায় বঙ্কিমের অন্যতম অবদান হচ্ছে ইংরেজি ‘ফ্যাশনে’ সফলভাবে বাংলা উপন্যাস লেখা। তিনি বাংলাকে, বিশেষ করে বাংলা গদ্যরীতিকে বিশেষ একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সময়ে বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বঙ্কিম হচ্ছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৬ সালে ঠাকুর কাব্যিক ভাষায় বঙ্কিমের প্রশংসা করে সঠিকভাবেই বলেছিলেন,
‘বাংলা ভাষায় পৃথিবীতে যতদিন থাকবে তিনিও (বঙ্কিম) ততদিন বেঁচে থাকবেন। কারণ তার কর্মে ভবিষ্যত যুগের সাহিত্যের জন্য মৌলিক উপাদান বিদ্যমান ছিল। তিনি একই সাথে অন্ধকার রাতের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মশাল ধরিয়ে দিয়েছিলেন, আবার ভাষার পরিবর্তন মেনে না নেয়ার অযোগ্যতাটিও দূর করেছিলেন’ [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রসমগ্র, ভলিউম ১৮, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা]।
ঠাকুর ১৯৩৬ সালে তার ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ কবিতাটি লিখেন। উপরে উদ্ধৃতিটি সেই কবিতার কয়েকটি লাইনের ভাবানুবাদ। বঙ্কিমের প্রশংসায় কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), যিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক খ্যাতিমান, একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
‘রবীন্দ্রনাথ যদি আমাদের ভারতবর্ষের আকাশে দুর্ভাগ্যের অন্ধকারের মধ্যে সূর্য হয়ে আভির্ভূত হয়ে থাকেন, তাহলে বঙ্কিম হচ্ছেন ভোরের আলোক রেখা’ [কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল রচনাবলী, ভলিউম ১১, নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সংকলন, বাংলা একাডেমি, ২০১২, ২৯১]।
আহমদ ছফা বলেছেন যে, ‘বঙ্কিম হচ্ছেন বাঙলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার হাত ধরেই বাংলা গদ্য একটি পরিণত রূপ লাভ করে এবং বিভিন্ন ধরনের মানবীয় আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করার মতো গতিশীল ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। [আহমদ ছফা, বাংলার সাহিত্যদর্শ, মোর্শেদ সাইফুল হাসান সংকলন, ‘আহমদ ছফা: নির্বাচিত প্রবন্ধ’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০০২, পৃষ্ঠা ৮৪]
বঙ্কিমের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উন্নয়নে কাজে আসেনি বরং, সাধারণভাবে ভারতের রাজনীতি এবং বিশেষভাবে বাঙলার রাজনীতির অনাগত ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক উন্নতির দার্শনিক ভিত্তি (Philosophical Direction) ছিল সাম্প্রদায়িক, যা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টিতে সহায়তা করে। বঙ্কিমের সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব এখনো ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
এ ক্ষেত্রে এটি বলাই যায় যে, বঙ্কিম একই সাথে সম্মানিত ছিলেন এবং কাজগুলো আদর্শিক ছিল। ২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাঙলার ‘উপনিবেশবিরোধী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী আন্দোলন’ এর সাথে জড়িতদের কাছে তিনি যেমন প্রেরণা ছিলেন, তেমনি বর্তমানেও উত্তর ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে সমানভাবে সম্মানিত।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকিকরণ প্রক্রিয়ায় বঙ্কিম এটা বুঝতে পারেন যে, চিন্তা এবং অনুভূতিকে স্পষ্ট এবং জঠিলতাহীনভাবে প্রকাশ করা খুবই জরুরি। আবার সেটা ‘স্পষ্ট এবং সম্পূর্ণভাবে’ বাংলায় প্রকাশের জন্য শব্দভান্ডার বৃদ্ধির বিষয়টিও অনুধাবন করেন। ফলে তিনি বিভিন্ন বিদেশী ভাষা থেকে উদারভাবে শব্দ গ্রহণের ‘পক্ষে’ ছিলেন। তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাঙলা ভাষা’তে ১৮৭৮ সালে বঙ্কিম লিখেছেন, ‘যা বলতে হবে স্পষ্টভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে বলতে হবে। স্পষ্ট ও সম্পূর্ণভাবে বলার সুবিধার্থে ইংরেজি, ফার্সি, আরবী, সংস্কৃত, রাস্টিক, সিলভান যে কোনো ভাষার শব্দকে গ্রহণ করুন যদি সেগুলো অশালীন না হয়। [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বাঙলা ভাষা: লিখিবার ভাষা, বঙ্কিম রচনাবলী: সাহিত্য সমগ্র, প্রথম তুলি-কালাম সংকলন, তুলি-কালাম, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৩৭৩]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪)
এখানে বঙ্কিম যেভাবে ‘যে কোনো ভাষার শব্দ’ গ্রহণের কথা বলেছেন তাতে তাকে উদার মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এমন ছিলেন না। সংস্কৃতের প্রতি তার সবিশেষ পছন্দ ছিল। একই প্রবন্ধে বঙ্কিম লিখেছেন, ‘বাংলা এখনো একটি অনুন্নত ভাষা। ফলে এখন অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বদা শব্দ দিয়ে সহায়তা করা সংস্কৃত থেকেই ধার নেয়া উচিত। প্রথমত, সংস্কৃত হচ্ছে ‘শব্দ ধার দেয়া’র মতো সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা, যেটি যে কাউকে তার চাওয়া মতো যে কোনো ধরনের শব্দ ধার দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত শব্দমালার সাথেই বাংলাকে বেশি মানায়, কারণ এর (বাংলার) মেরুদন্ড, শিরা-উপশিরা সংস্কৃত দিয়েই তৈরি।’ [প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭২]। এখানে এটা বলে রাখা প্রাসঙ্গিক যে, ভাষাবিদরা, এমনকি বাঙালী ভাষাবিদরাও বাংলা ভাষার উৎপত্তির (Philological root ) ইতিহাসের ব্যাপারে একমত নন।
শেষের উদ্ধৃতিটিতে বিদেশী ভাষা থেকে শব্দ নেয়ার বিরোধীতা করা বঙ্কিমের যে রূপ দেখা যাচ্ছে তা আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তৎকালীন মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে সবেচেয় বেশি সংস্কৃত প্রভাবিত লেখক মীর মশাররফ হোসেনে ভাষাগত ব্যবহারের ব্যাপারে বঙ্কিমের একটি প্রশংসা থেকে। ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন প্রকাশিত জমিদার দর্পন বইটির গদ্যরীতির প্রশংসা করে বঙ্কিম লিখেছেন,
‘এতে মুসলমানি বাংলার কোন ছাপ নেই। এবং এই মুসলিম লেখকের বাংলা ভাষা অনেক হিন্দু লেখকের ভাষার চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ।’ [সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ বইয়ে বঙ্কিমের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। ইউপিএল, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ২৮]।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালীন মুসলিম গদ্য লেখকরা মুসলিম সমাজের সাধারণ্যে শত শত বছর ধরে বহুল ব্যবহৃত আরবী-ফার্সি শব্দাবলীকে তাদের সাহিত্যে বেশ ব্যবহার করতেন। কিন্তু বঙ্কিমের কাছে এই ধরনের ‘মুসলমানি’ কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকা বাংলা ভাষাটি ‘বেশি বিশুদ্ধ’ । বুঝাই যাচ্ছে, ভাষাবিজ্ঞানের মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দ ও ভাষার ‘বিশুদ্ধতা’ ও ‘অশুদ্ধতা’র ধারণাটি যে পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ, তা বঙ্কিম মনে করতেন না।
বাঙালী ভাষাতত্ত্ববিদ শ্যামাচরণ গঙ্গপাধ্যায়/গাঙ্গুলী ১৮৮৭ সালে তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশুদ্ধতার ধারণাটি মারাত্মকভাবে অপরিপক্ক এটি মূলত এক ধরনের সংকীর্ণতা থেকে উৎসারিত। বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে অবাধে চলাফেরা-মেলামেশা হওয়ার ফলে লেনদেনের (ভাষাগত) বিষয় অবশ্যই থাকবে। যখন মানুষ তাদের রক্তকেই ‘বিশুদ্ধ’ রাখতে পারে না, তখন ভাষাকে ‘বিশুদ্ধ’ রাখার চিন্তা করার চেয়ে অদ্ভুত কিছু কি আছে? মানুষের কোনো ভাষাই কখনো পুরোপুরি বিশুদ্ধ ছিল না। দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশী বিষয়াদির আগমন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে।… ফলে মানুষের ভাষা অবশ্যই মিশ্রিত, অবিশুদ্ধ, বহুপক্ষীয় হবেই। ‘গরীব’ বা ‘দাগ’ এর মতো শব্দগুলোকে তাদের বিদেশী সম্পৃক্ততার কারণে বই থেকে বাদ দেয়া হবে সবচেয়ে অযৌক্তিক কাজ। বর্তমানে ব্যবহৃত আরবী এবং ফার্সি মূলের শব্দগুলো আমরা যারা বাঙালী হিন্দু তাদেরকে বাঙালী মুসলমানদের সাথে, সারা ভারতের মুসলমানদের সাথে এমনকি আরবও পারস্যের মানুষদের সাথেও সম্পর্কযুক্ত করছে। শুধু সংস্কৃত ভাষায় কথা বলা আমাদের পূর্বপুরুষদের একটু ‘নিকটবর্তী’ হওয়ার আশায়আমাদের দেশের একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের সাথে, যাদের আমাদের ‘সহবাহসও হয়েছে’ এমন প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের সম্পর্কের সুতোটি নষ্ট করে দেয়া কি খুব বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে? [শ্যামাচরণ গঙ্গপাধ্যায়, ‘বেঙ্গলী স্পোকেন এন্ড রিটেন’, ই. লেথব্রিজ কলকাতা রিভিউ, ভলিউম এলএক্সভি, একাডেমি পত্রিকা, তৃতীয় ইস্যু, পশ্চিম বাংলা একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, মে ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ২২-২৩]
এখনো বহু মানুষ তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য নিজেদের দেশে বেঁচে থাকা সহ-নাগরিকদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শ্যামচরণ গঙ্গপাধ্যায় এ বিষয়ে হিন্দুদের আচরণের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
‘মৃত পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্ক (আত্মিক) তৈরির চেয়ে বেঁচে থাকা আশপাশে মানুষের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিই মানুষের সুখ শান্তি বৃদ্ধিতে বেশি ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু অনেক সময় মানুষ এসব বিষয় বিবেচনায় যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়। বাঙালী হিন্দুরা যে অনুভূতির দ্বারা তাড়িত হয়ে সংস্কৃতের দিকে ঝুঁকে তা বুঝা খুবই সহজ। ভারতের গৌরবময় দিনগুলির সাথে সংস্কৃত জড়িত। আর আরবী ও ফার্সির প্রভাবের দিনগুলি হচ্ছে এর (ভারতের) পরাজয়, অপমান ও শিকলবদ্ধ হওয়ার দিন। ফলে স্ফুটনোন্মুখ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই আরবী-ফার্সি শব্দকে তাদের দাসত্বেও শিকল হিসেবে মনে করে সেগুলোকে পরিহার করে চলে’ [প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ২৩]।
শ্যামচরণ গঙ্গপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তির ব্যাপারে বঙ্কিম সচেতন ছিলেন। কিন্তু তার ‘স্ফুটনোন্মুখ দেশপ্রেম’ তাকে শুধু আরবী-ফার্সি থেকে আগত ‘মুসলমানি’ শব্দ গ্রহণ থেকে বিরতই রাখেনি, বরং বেঙ্গলের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় এখানকার হিন্দুদের থেকে মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্ন করার বিনিময়ে হলেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে জাগিয়ে তোলার পেছনে তার মেধাকে খরচ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। [বঙ্কিম নিজে শ্যামচরণের যুক্তির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এটা বঙ্কিমের বিখ্যাত ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে শ্যামচরণকে উদ্ধৃত করা থেকে স্পষ্ট হয়। দেখুন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, ভাঙালা ভাষা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭১]।
বঙ্কিমের হিন্দুত্ব-প্রভাবিত গদ্য বেশ ফল দিতে শুরু করে। বিশেষ করে তার তথা কথিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বেঙ্গলকে ধর্মীয় দিক থেকে ভাগ করতে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্কিম তার আধুনিক উপন্যাসের সাহিত্যিক রূপকে ব্যবহার করে মুসলমানদের বাদ দিয়ে একটি হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্র গঠনে তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাকে তুলে ধরেন। এটা করতে গিয়ে ভারতে মুসলমানদের শাসনকে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করতে হয়েছে। একই সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশকদের নানা নিপীড়নকে এড়িয়ে গিয়ে তাদের মহিমান্বিত করে তুলো এবং এখানকার মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খারাপভাবে চিত্রিত করতে হয়েছে। তিনি তার কথিত ‘ইতিহাসনির্ভর’ উপন্যাস যেমন, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, সিতারাম এবং রাজ সিঙ্গা’য় এর সবই করেছেন।
উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে ভারতে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের ‘চেতনাপুরুষে’ পরিণত হন বঙ্কিম। তার আনন্দমঠ হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতেহারে হিসেবে গৃহিত হয়। বঙ্কিম যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে মুসলমানদের কোন সম্মানজনক অবস্থান ছিল না বললেই চলে।
‘আনন্দমঠ’কে অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয়াংশে বাঙলার উপনিবেশবিরোধী কৃষকসমাজের বিদ্রোহের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে লেখা উপন্যাস বলে দাবি করা হয়ে থাকে। ইংরেজদের উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে বহু সংখ্যক কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাঙলা এবং বিহারে কলকাতাভিত্তিক ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিরুদ্ধে যে ক’টি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে সেগুলো ইতিহাসে সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বলে খ্যাত। বঙ্কিম তার আনন্দমঠ এইসব বিদ্রোহকে উপজীব্য করে রচনা করেন, যেগুলোর আয়োজনে এবং অংশগ্রহণে হিন্দু সন্যাসী ও মুসলমান ফকির উভয়পক্ষ ছিল।
কিন্তু উপন্যাসে এসব বিদ্রোহ থেকে মুসলমান ফকিরদের অংশগ্রহণ ও ত্যাগকে বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু সন্যাসীদের একক আন্দোলন হিসেবে দেখিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি বঙ্কিম, বরং এগুলোকে তিনি ‘প্রধানত বাঙলার নিপীড়ক মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ হিসেবে দেখিয়েছেন। ইতিহাস বলছে, ফকির ও সন্যাসীদের বিদ্রোহের সময়ে মুসলমানরা বাঙলা শাসন করছিল না। এমনকি বঙ্কিমও তার উপন্যাসের দুই জায়গায় ওয়ারেন হেস্টিংসকে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, উপন্যাস সমগ্র, খান ব্রাদার্স এন্ড কো., ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৬১, এবং ৭৮৫। ওয়ারেন হেস্টিংস বাঙলার প্রথম গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৭৭২ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত।
‘শত্রুসেনা’, যারা আনন্দমঠের বিদ্রোহী বা সন্তানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিল তাদেরকে উপন্যাসে ‘তৈলাঙ্গি, মুসলিম, হিন্দুস্তানী এবং ইউরোপিয়ান’ এসব পরিচয়ে তুলে ধরা হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন থমাস নামের এক আইরিশ ক্যাপ্টেন। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭৭] কিন্তু এই ‘শত্রুসেনা’দের বিরুদ্ধে যখন হিন্দু বিদ্রোহীরা পাল্টা লড়াই করতে নামে তখন তাদের স্লোগান ছিল ‘মার মার নেড়ে মার।’ (নেড়ে বলতে মুসলমানদেরকে বুঝানো হতো) [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭২]।
বঙ্কিম তার আনন্দমঠ’সহ সবগুলো ‘ইতিহাসনির্ভর’ উপন্যাসে মুসলমানদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে নানা কটুক্তিমূলক শব্দ যেমন- নেড়ে, যবন, ম্লেচ্ছ- ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি মুসলিমদেরকে হত্যা করার সময় অনেক হিন্দু বিদ্রোহীকে পাওয়া গেছে যারা খুব আগ্রহভরে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ভাই, এমন দিন কি আসবে না যখন আমরা মসজিদের ধ্বংসস্তুপের ওপর রাধামাধবের মন্দির নির্মাণ করতে পারবো?’ [প্রাগুক্ত]
এসবের মধ্যে হিন্দু বিদ্রোহীদের এক নেতা ভবনানন্দকে দেখা যায় তিনি ‘শত্রুসেনা’দের ইউরোপিয়ান ক্যাপ্টেন থমাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলছেন, ‘মি. ক্যাপ্টেন, আমরা আপনাকে হত্যা করবো না। ইংরেজরা আমাদের শত্রু নয়। আপনি এখানে কেন মুসলমানদের সাহায্য করতে এসেছেন? আসুন, আপনাকে আমরা জীবনের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। শুধু কিছু সময় আপনি যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকবেন। ইংরেজরা বিজয়ী হোক। আমরা আপনাদের বন্ধু। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭৬]।
[উৎসঃ নুরুল কবির এর লেখা Colonialism, politics of language and partition of Bengal, ৩৫ পর্বের ধারাবাহিক অনুবাদ।লেখক এই সিরিজটি তার সম্পাদিত ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকায় ২০১৩ সালে প্রকাশ করেন। প্রথম ১১ পর্বে তিনি বাংলা ভাগের রাজনৈতিক কারণগুলো আলোচনা করেছেন।সেই ১১ পর্ব নিয়ে মূলধারা বাংলাদেশ একটি ই-বই প্রকাশ করেছে। সেই বই এবং পর্ব আকারে লেখা পেতে লিংকে ক্লিক করুন ]
পরের পর্ব-পর্ব ৮
প্রাসঙ্গিক পোষ্টঃ
বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা ৩
মুসলমান বাংলা লিখিতে জানে না– মহাকবি কায়কোবাদ এর সে সময়ের অভিজ্ঞতা
ঢাকার প্রমিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক উপনিবেশের প্রভাব
সাম্প্রদায়িকতাঃমুক্ত নন রবীন্দ্রনাথও
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রদায়িক চেহারা
http://www.muldharabd.com/?p=816
২০১৭ সাল-৩৩ তম সপ্তাহঃ মুক্তি ও শোকের আগষ্ট, ঘটনাবহুল ৪৭ এবং ৭৫
মূলধারা বাংলাদেশ· SUNDAY, 20 AUGUST 2017
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও কুখ্যাত কোলকাতা হত্যাযজ্ঞ
কলকাতা দাঙ্গার দায়ভারঃ মুসলিম লীগের কোন প্রস্তুতিই ছিলনা
কলকাতা দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াঃ নোয়াখালী দাঙ্গা ও কলকাতা কেন্দ্রিক প্রোপ্যাগান্ডা মিশন
পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠা কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম-শেখ মুজিবুর রহমান
১৯০ বছরের গোলামী থেকে মুক্তির দিন আজান দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল পূর্ববাংলার অধিবাসীরা
শিশুরাষ্ট্র হিসেবে পূর্ববঙ্গের যাত্রা শুরু
'আর পাকিস্তানে যেতে চাই না': বিহার থেকে আসা উর্দুভাষীদের অবস্থা
সিলেট আসল বাংলাদেশে কিন্তু করিমগঞ্জ চলে গেল ভারতে!
দেশভাগে উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না
Partiton 1947: Indian Muslims become second class citizen: Kuldip Nayar
আগষ্ট ১৯৭৫
বঙ্গবন্ধুর মত জনপ্রিয় নেতার এমন পরিণতি কেন হলো?
আওয়ামীলীগের একটা অংশ পরিবর্তন চাচ্ছিলো, এবং ১৫ আগস্টের ঘটনায় অনেকেই খুশি হয়েছে-মহিউদ্দিন আহমদ
চাটুকার ও সুযোগসন্ধানীদের ক্ষপ্পরে পড়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান
মুজিব পুজার সুত্রপাত
১৫ আগষ্টের প্রেক্ষাপট: দেশের পরিস্থিতি যা ছিল
আগষ্ট হত্যাকান্ড ও 'এক বাক্সে সকল ডিম না রাখার' ভারতীয় নীতি
আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পতন চেয়েছি ও রক্তাত্ব বিরোধিতা করেছি-জাসদ
'শেখ মুজিবের লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া উচিত ছিল'-কর্ণেল তাহের !
'ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল, তিনি পারলেন না'-অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
বিবিধ
ষোড়শ সংশোধনী বাংলাদেশকে 'আওয়ামী লীগের প্রজাতন্ত্রে' পরিণত করতে চেয়েছিল-বদরুদ্দিন উমর
খিলাফত আন্দোলন থেকেই বাঙ্গালী মুসলমানের রাজনৈতিক নেতাদের উঠে আসা
'ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল, তিনি পারলেন না'-অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
প্রাসঙ্গিক আগের সপ্তাহের পোষ্টের লিংকঃ
২০১৭ সাল-৩২ তম সপ্তাহঃ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ও দেশভাগ