বনানীতে ইলিয়াস আলীকে যেভাবে অপহরণ করা হয় : মোবাইল ট্র্যাক করে অপহরণকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব
স্টাফ রিপোর্টার
মধ্যরাতে বনানীর নির্জন সড়ক থেকে বিএনপির জনপ্রিয় সাহসী নেতা এম ইলিয়াস আলীকে অপহরণ নিয়ে রহস্য ক্রমেই দানা বাঁধছে। র্যাব, সিআইডিসহ পুলিশের নীরব ভূমিকা শঙ্কাকুল করে তুলেছে সবাইকে। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ঘটনার পর গতকাল পর্যন্ত গোয়েন্দারা ঘটনাস্থল থেকে কোনো ধরনের আলামত সংগ্রহ করেনি। সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট সেখানে যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে আলামত যাতে নষ্ট হয়, সে জন্যই এই নীবরতা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলটি নির্জন। মধ্যরাতে লোক চলাচল খুবই কম।
পরিকল্পিতভাবেই অপহরণের জন্য ওই জায়গাটি বেছে নেয়া হয়। রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে ঘটে অপহরণ। প্রথমে সাদা পোশাকের একদল লোক ইলিয়াস আলীকে তার গাড়ি থেকে বের করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এ সময় ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনেছেন তারা। ড্রাইভার আনসারকে ওই সময় কিংবা কয়েক মিনিট পর তারা তুলে নেয়। দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শী এমন ধারণা দিয়েছেন যে, আনসারকে ধাওয়া করে অপহরণকারীরা ধরে ফেলে। তাদের বর্ণনায়— এক্ষেত্রে নেয়া হয় বিশেষ কৌশল। ইলিয়াস আলীকে বহনকারী গাড়িটিকে গুম মিশনের লোকজন বহনকারী মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, যাতে ইলিয়াস গাড়িটি থামান। ইলিয়াসের প্রাইভেটকার থামতেই অপহরণকারীরা হুটহাট নেমে পড়ে ইলিয়াসকে জেরা করে মাইক্রোতে তুলে নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা গাড়ি ধাক্কার শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
এদিকে ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী কিশোর টোকাই রনি ঘটনার পর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর পুলিশি তত্পরতার কথা বললেও বাস্তবতা তার উল্টো।
পুলিশ ও গোয়েন্দারা নামকাওয়াস্তে কিছু খোঁজখবর করছে, যা নিতান্তই আইওয়াশ। সরকার ও গোয়েন্দারা চাইলে মোবাইল ট্র্যাক করেই অপহৃত ও অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারে। অথচ তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। র্যাব বিবৃতি দিয়ে দায় এড়িয়েই খালাস। তারা কোনো ধরনের অ্যাকশনে যায়নি। পুলিশের সিসিটিভি ক্যামেরায়ও অপহরণ দৃশ্য থাকার কথা, ট্রাফিক সিগন্যাল ও প্রতিটি মোড়েই সিসিটিভি রয়েছে। মহাখালী ফ্লাইওভার এলাকার সিসিটিভির মাধ্যমে ঘটনাস্থল কভার দেয়ার কথা। সেসব ফুটেজ মনিটর করলেই ওই সময় ওই রাস্তায় কোন গাড়ি চলাচল করেছে, তাতে যাত্রী কারা ছিল তা ধরা পড়ার কথা। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে গতকাল ঘটনাস্থল ঘুরে সরেজমিন তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে।
গতকাল সকাল ১১টার দিকে বনানীর সাউথ পয়েন্ট, ১ নম্বর রোড, ২ নম্বর ও ৪ নম্বর রোড, ২ নম্বর রোডের মসজিদ গলি, মহাখালী কাঁচা বাজার এলাকা, মহাখালী ফ্লাইওভার, এরশাদনগর বস্তি ও বনানী থানা এলাকায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে নানা তথ্য ।
বনানী দুই নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাপারেল গার্মেন্ট ভবনের ৯ তলার একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে তিনি আতঙ্কিত। পরদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় তিনি জানতে পারেন এ ঘটনায় একজন বিএনপি নেতা ও তার গাড়িচালক নিখোঁজ হয়েছেন। হয়রানির ভয়ে তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
এদিকে এ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থলের রাস্তার পূর্বপাশে অবস্থিত নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড লুত্ফরকে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ তাকে আটক করে গুলশান জোনের ডিসির কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ছেড়ে দেয়। লুত্ফরের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। সে জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে তার ডিউটি ছিল। নির্মাণাধীন ১৮ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাজ চলছিল। সেখানে একটি চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় গভীর রাতে ভবনের সামনের রাস্তায় বিকট গাড়ির শব্দে সে ভয় পেয়ে যায়। নিচে লোকজনের চিত্কার ও উচ্চ শব্দে কয়েকজন কথা বলছে। সে ভয়ে প্রথমে দূরে সরে যায়। পরে দেখতে পায় কয়েকজন লোক ধস্তাধস্তি করছে। কিছুক্ষণ পর দেখতে পায় একটি মাইক্রোবাসের সামনে পুলিশের দুটি গাড়ি। এ দৃশ্য দেখে সে ভয়ে বাইরের দিকে না তাকিয়ে ঘুমাতে যায়। ভয়ে সে এ ঘটনা আর কাউকে জানায়নি। তার ধারণা, কেউ হয়তো কাউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঝামেলা হতে পারে ভেবে বিষয়টি কাউকে জানাতে চায়নি। বেলা সাড়ে তিনটায় বনানী থানা থেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছেন। খোঁজ নেই তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক আনসারেরও। ইলিয়াস আলী মঙ্গলবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সিলভার রঙের যে গাড়ি নিয়ে বনানীর নিজ বাসা থেকে বের হন, ওই গাড়িটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার গভীর রাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গাড়িটি উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ।
ইলিয়াস সর্বশেষ ফোন করেন রূপসী বাংলা থেকে : বিডিনিউজ জানায়, বন্ধ হওয়ার আগে বাংলা মোটর, ইস্কাটন ও রূপসী বাংলা হোটেল (শেরাটন
এলাকায় এম ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করেছে র্যাব।
র্যাব আরও জানতে পেরেছে, মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে সিলেটের এক সাংবাদিকের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল সিলেট-২ আসনের এই সাবেক সংসদ সদস্যের।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানীর বাড়ি থেকে দু’জন ব্যক্তির সঙ্গে ইলিয়াস আলীর গাড়িতে ওঠার তথ্য পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও তাদের নাম-ধাম কিছুই জানতে পারেনি র্যাব।
বুধবার প্রথম প্রহরে (রাত দেড়টার দিকে
মহাখালীর আমতলী সংলগ্ন একটি গলিতে ইলিয়াস আলীর গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে পাওয়া যায়নি ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসারকে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাত ১২টা ২ মিনিটে সিলেটের ওই সাংবাদিকের সঙ্গে ইলিয়াস আলীর সর্বশেষ কথা হয়। তখন ইলিয়াস আলীর মোবাইলের অবস্থান ছিল ইস্কাটন এলাকায়।
‘র্যাবের একজন কর্মকর্তা ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কিছু লেখালেখি করা যায় কি-না তা নিয়ে তাদের কথা হয়েছে বলে ওই সাংবাদিক র্যাবকে জানিয়েছেন’, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই রাতে বাংলা মোটর, ইস্কাটন, শেরাটন হোটেল এলাকায় ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে।
ওই রাতে রূপসী বাংলা হোটেলে ইলিয়াস আলী গিয়েছিলেন এবং এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা ছাড়াও সিলেট বা ঢাকায় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পারিবারিক কোনো দ্বন্দ্ব এর মধ্যে ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাংবাদিকের আগে চালক আনসারের সঙ্গে মোবাইলে ইলিয়াসের কথা হয় বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, রাত দেড়টার দিকে আমতলীর গলিতে দরজা খোলা অবস্থায় ইলিয়াস আলীর গাড়িটি পড়ে ছিল। ইলিয়াসের বাড়ি ওই স্থানের কাছেই।
গাড়িতে চালক আনসারের মোবাইল ফোন পড়ে ছিল। এটি যে ইলিয়াসের গাড়ি, ওই মোবাইল থেকে কল করেই পুলিশ তা নিশ্চিত হয়।
ইলিয়াস আলীর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শফিকুর রহমান ও পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুজনকে সঙ্গী করে প্রাইভেটকারটি নিয়ে বের হন বিএনপি নেতা। গাড়ি চালাচ্ছিলেন আনসার। এই দুজন কারা ছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি বলে র্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘তদন্তের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব তথ্য দরকার, ইলিয়াস আলীর পরিবার বা তার দলের পক্ষ থেকে সে ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে তদন্তকাজ দ্রুত হতো।’
কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে সরকার ‘গুম’ করেছে বলে বিএনপির অভিযোগ। স্বামীর সন্ধান চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে রিট আবেদনেও তা বলেছেন ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সরাসরি বলেছেন, ‘র্যাবের লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।’
তবে র্যাব ও পুলিশ জানিয়েছে, ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইলিয়াস নিখোঁজের এ ঘটনা বিএনপির ‘নাটক’।
গুমের আগের ঘটনাগুলো : আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত যুবদলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে রূপসী বাংলা হোটেলে ছিলেন ইলিয়াস। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি বনানীর নিজ বাসার দিকে রওনা হন। গাড়ি থেকে উদ্ধার করা ফোনের কললিস্ট ধরে বিভিন্ন নম্বরে ফোন করে পুলিশ নিশ্চিত হয়, গাড়িটি ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর। মোবাইল ফোনের সেটটি ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসারের। এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি
করেছেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা।
লুনা বলেন, ছোট ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টায় আমি বাসায় ফিরি। এ সময় বাসার নিচে ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়। গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিল ইলিয়াস। বাসার নিচে দেখা হওয়ার পর ছেলের অসুখের ব্যাপারে চিকিত্সক কী বলেছেন তা আমার কাছে জানতে চায়। বাসার নিচে এ সময় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী সফু, যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলীসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। রাত দেড়টার দিকে বনানী থানা থেকে পুলিশ সদস্য পরিচয়ে আমার মোবাইলে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা হয়, ঢাকা মেট্রো-গ-২৯-৪৪১৫ নম্বরের গাড়িটি আমাদের কি-না। এরপর থানায় গিয়ে গাড়িটি শনাক্ত করি। তবে পুলিশ আমার স্বামীর খোঁজ দিতে পারেনি। স্বামীকে খুঁজে পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন লুনা।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী আরও বলেন, মঙ্গলবার রাতে যুবদল নেতা নেওয়াজকে নিয়ে একজন আইনজীবীর বাসায় যান ইলিয়াস। আইনজীবীর বাসা থেকে বের হওয়ার পর নেওয়াজকে রেখে বাসার উদ্দেশে রওনা হন ইলিয়াস। এরপর তার খোঁজ নেই। বন্ধ পাওয়া যায় ইলিয়াসের মোবাইল ফোন।
পৌনে ১২টা পর্যন্ত রূপসী বাংলায় ছিলেন ইলিয়াস : যুবদল নেতা নেওয়াজ জানান, রাত পৌনে ১০টার দিকে বনানীর বাসা থেকে ইলিয়াস ভাইয়ের গাড়িতে আমরা রূপসী বাংলা হোটেলে যাই। গাড়িতে চালক ছাড়াও যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমজাদ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। হোটেলের লবিতে বসে আইনজীবী আহসান হাবিবের জন্য অপেক্ষা করেন ইলিয়াস ভাই। কয়েক দফা ফোন করার পরও হাবিব আসেননি। পৌনে ১২টার দিকে রূপসী বাংলা হোটেলের বাইরের লবির আলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল। এ সময় ইলিয়াস ভাই আমাদের নিয়ে হোটেলের বাইরে এসে নিজ গাড়িতে উঠে বাসার দিকে রওনা হন। আমি আমার আজিমপুরের বাসায় ফিরে আসি। সকালে জানতে পারি, ইলিয়াস ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না।
যেভাবে শনাক্ত হয় গাড়ি ও মোবাইল : মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে বনানীর আমতলী ক্রসিং সংলগ্ন সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত
পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন টহল পুলিশের সদস্যরা। গাড়িটি দরজা খোলা অবস্থায় ছিল। গাড়ির ভেতরে একটি মোবাইল ফোনও পাওয়া যায়। টহল পুলিশ ওয়াকিটকিতে বিষয়টি বনানী থানা পুলিশকে জানায়। পরে উদ্ধার করা মোবাইলের কললিস্ট ধরে পুলিশ প্রথমে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদকে ফোন করে। তার কাছেই পুলিশ নিশ্চিত হয় মোবাইলটি ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসারের। গাড়ির মালিক ইলিয়াসের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার লুনা।
মাঠে দেখা যায়নি র্যাব-সিআইডিকে : এত বড় একটি ঘটনা তদন্তে র্যাব, সিআইডি কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো সদস্য ঘটনাস্থলে যায়নি। সাধারণত চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা র্যাব তদন্ত করে। কিন্তু এম ইলিয়াস আলী চালকসহ গুম হওয়ার মতো এমন আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা তদন্তে র্যাবকে দেখা যায়নি। যদিও ঘটনার পর থেকেই পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে গুমের ঘটনায় র্যাবকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তারা এ ঘটনা না ঘটালেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার কথা। কিন্তু অভিযোগের ইঙ্গিত দেয়া র্যাব সদস্যরা কেউ গতকাল ঘটনাস্থলে যায়নি। তবে সকাল থেকেই নতুন উদ্বোধন করা বনানী থানা পুলিশকে দেখা গেছে। পুলিশের ৭-৮ জনের একটি দল ঘটনাস্থলে বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড লুত্ফর ও মাসুদ রানাকে ছাড়াও ওই ভবনের ৬ জন নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেন। অপর সিকিউরিটি গার্ড মাসুদ রানা জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল তার। ১০টা থেকে বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল লুত্ফরের। মাসুদ রানার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। সে তিন মাস ধরে এখানে আছে। তবে নির্মাণ শ্রমিকরা এ বিষয়ে পুলিশকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এছাড়া সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পাঁচ সিকিউরিটি গার্ড ও একজন অফিস সহকারীকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সকালে স্কুলে গিয়ে পুলিশের দুটি টিম পৃথকভাবে জিজ্ঞাসা করে ইলিয়াস আলী নিখোঁজের বিষয়ে তারা কিছু জানে কি-না। কিন্তু তারা পুলিশকে জানিয়েছে, বিকাল সাড়ে তিনটায় স্কুল ছুটি হওয়ার পর সিকিউরিটি গার্ডরা ছুটি পায়। তারা স্কুলের ভেতরে নিচতলায় একটি কক্ষে থাকে। রাতে স্কুলের বাইরে তারা ডিউটি করে না। স্কুলের সামনের রাস্তায় ঘটনাটি ঘটলেও তারা কোনো শব্দ পায়নি বলে জানায়।
নির্জন এলাকা : ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে আমতলী যেতে বাঁদিকে বনানী দুই নম্বর সড়কে ঢুকেই সামান্য দূরে সাউথ পয়েন্ট স্কুল। তার একটু আগে রাস্তার পূর্বপাশে নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ার। এ ২ নম্বর সড়ক থেকে সামান্য দূরেই ২/১ নম্বরে সিলেট হাউস। ৬তলা ভবনের পাঁচ তলায় সপরিবারে থাকেন এম ইলিয়াস আলী। তিনি প্রতিদিনই এ সড়ক দিয়ে চলাফেরা করেন। তবে রাত ১০টার পরই রাস্তাটি নির্জন এলাকায় পরিণত হয়। মহাখালী সড়ক ব্যস্ত থাকলেও দুই নম্বর সড়কটির শুরু থেকে সাউথ পয়েন্ট স্কুল পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে আবাসিক ভবন বা দোকানপাট নেই। মহাখালী থেকে সড়কে ঢুকে সাউথ পয়েন্ট স্কুল পর্যন্ত যেতে পশ্চিম দিকটা একেবারেই খালি। পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ার। সেখানেও পর্যায়ক্রমে একজন সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া কেউ থাকে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাটি ঘটেছে এ নির্জন এলাকাতেই। ইলিয়াস আলীর ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটিও পাওয়া গেছে ঠিক নুরানী টাওয়ারের সামনে। ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণকারী চক্রটি পরিকল্পিতভাবেই এ স্থানটি বেছে নিয়েছে। এলাকাটি নির্জন ও জনবসতিপূর্ণ না হওয়ায় ইলিয়াস আলীকে সেখানেই টার্গেট করা হয়। যেহেতু তিনি নিয়মিত এ রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করেন, তাই আগে থেকেই অপহরণকারীরা এখানে ওত পেতে ছিল। তারা ইলিয়াস আলীর গাড়িটি মহাখালী থেকে দুই নম্বর সড়কে ঢোকার পরই পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে পেছনের বাম্পার মাঝখান থেকে বাঁকা হয়ে যায়। বামপাশের ব্যাক লাইটও ভেঙে যায়। দাগ পড়ে যায় পেছনে। হয়তো ইলিয়াস আলীকে প্রাইভেট কার থেকে নামানোর কৌশল করতেই ধাক্কা দেয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে আসার পরই ইলিয়াস আলী ও তার চালক আনসার আলীকে অস্ত্রের মুখে আটক করে নিয়ে যায়। পরে গাড়িটি রাস্তায় দরজা খোলা অবস্থায় পায় পুলিশ। টহল পুলিশের এএসআই মাহবুব জানান, তিনি ওই রাতে গাড়িটি নূরানী টাওয়ারের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ঠেলে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে নিয়ে রাখেন। রাস্তায় যান চলাচলে বিঘ্ন না হয় সেজন্য তিনি গাড়িটি সরিয়ে রেখেছেন। পরে প্রাইভেট কারটি বনানী থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে আলামত হিসেবে গাড়িটি জব্দ করে বনানী থানার সামনে রাখা হয়েছে।
ড্রাইভার কি পালানোর চেষ্টা করেছিল : ইলিয়াস আলীকে অপহরণের মুহূর্তে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার আনসার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্তত দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের বাড়ি দেখাশোনা করে মো. জসিম। জসিম জানান, তিনি একা নন বিষয়টি অনেকেই দেখেছেন। স্কুলের সামনে কয়েকজন মিলে একজনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। দূর থেকে চিনতে না পারলেও সকালে সংবাদ শুনে সবাই সন্দেহ করেন ওই একজন ইলিয়াস আলীর গাড়ির চালক আনসার আলী। কারণ তারা সেখানে একজনকে সাদা মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ইলিয়াস আলীকে কি তার আগ মুহূর্তেই মাইক্রোবাসে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ইলিয়াস আলীকে বনানীর ২ নম্বর সড়কে অপহরণের মুহূর্তে তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে অপহরণকারীরা তাকে ধাওয়া করে সহজেই ধরে ফেলে এবং গাড়ির পেছন দিকে ধাক্কা দেয়। জসিম বলেছেন, যাদের সঙ্গে প্রাইভেট কারের আরোহীর ধস্তাধস্তি হয়েছে তারা সাদা পোশাকের লোকজন। জসিম নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীর রেফারেন্স টেনে জানালেন, ইলিয়াস আলীকে সাউথ পয়েন্ট থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে অপহরণ করা হয়েছে। জসিম কয়েকজন পথচারীর রেফারেন্স দিয়ে জানান, গাড়ির শব্দ শুনে বাইরে বের হলে পথচারীরা জানিয়েছে একজনকে গাড়ির মধ্য থেকে বের করে কে বা কারা অপহরণ করেছে। এ সময় ওই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে সাউথ পয়েন্টে ঢোকার চেষ্টা করলে ধাওয়া করে পেছন থেকে অন্য গাড়ি দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিলে শব্দ হয়। একই ঘটনার বর্ণনা দেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও দু’টি ভবনের কয়েকজন।
বনানী ২ নম্বর রোডের মসজিদ গলির মমতা টেলিকমের ব্যবসায়ী জানান, রাত প্রায় ১২টার সময় ১৪ নম্বর বাড়ির নানা তাদের দোকানের কাছে এসে জানায়, এইমাত্র গাড়ি থেকে কারে যেন কয়েকজন লোক টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেছে। এ সময় তারা দৌড়ে গলির মাথায় গেলে শুধু গাড়ি পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় গাড়ির ইমার্জেন্সি লাইট এবং হেডলাইট জ্বলতে দেখেন তারা। ১৪ নম্বর বাড়ির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, তারা কিছু একটার শব্দ শুনে বের হন। আর বাড়ির সামনে মসজিদের গলিতে ৫-৬টা দোকান থাকায় প্রতিদিন প্রায় ১২টা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য থাকে। এ সময় পথচারী কয়েকজন তাদের বললে তারা বাইরে এসে প্রায় ২০০ গজ দূরে টেনেহিঁচড়ে নিতে দেখেছেন। তবে রাতের আধো আলো আধো অন্ধকারে স্পষ্ট করে কারও মুখ চিনতে পারেননি। এরশাদ নগর বস্তির টোকাই আবদুর রহমান (১৪
জানায়, ওই রাস্তা দিয়ে সে মহাখালী কাঁচাবাজারে আলম ঠিকাদারের কাছ থেকে ফেরার সময় শুধু গাড়িটাকে পড়ে থাকতে দেখে। এ সময় গাড়ির সব আলো জ্বলছিল। গাড়িতে কেউ ছিল না। এমনকি প্রতিদিন এ সময় দোকান খোলা থাকলেও সেদিন খোলা ছিল না। রাস্তা ছিল নীরব-নির্জন।
একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী রনির হদিস নেই : অপহরণের ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছিল টোকাই রনি। কিন্তু গতকাল কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি রনিকে। সেদিন রাতে রনি সাউথ পয়েন্টের ডাবের খোসা সরানোর কাজ করছিল। স্কুলের সামনে খোলা মাঠের ভিতরের অংশে ফুটপাত ঘেঁষে কয়েকজন ডাব বিক্রেতা খোসা ফেলে রেখে যায়। যা রনি একদিন পর পর রাতে তুলে নেয়। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে রনি খোসা তুলতে আসে বলে জানায় টোকাই আবদুর রহমান, শাওন ও রহিম। একই প্রসঙ্গে ডাব বিক্রেতারা সত্যতা স্বীকার করে জানান, ওই রনি ডাবের খোসা তুলে নিয়েছিল এবং রনি কাজটা ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকেই করে বলে জানায় এক ডাব বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম। রনি সকাল-বিকাল মহাখালী কাঁচাবাজারের ডাস্টবিন থেকে ভাঙাড়ি কুড়ায়—এমন তথ্যে সেখানে গেলে অন্য কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও রনিকে পাওয়া যায়নি। ভাঙাড়ি কুড়ানো কয়েকজন জানায়, রনি ওই ঘটনা দেখেছে বলে জানিয়েছে। বেলতলা এরশাদনগর বস্তিতে খুঁজলেও রনিকে পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : টহল পুলিশের এএসআই মাহবুব রহমান জানান, তার টহল এ এলাকায় ছিল না। মহাখালী কাঁচাবাজারে টহল শেষে ফেরার পথে গাড়িটি আলোবিহীন পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে জানান দৈনিক আমার দেশ-কে। বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মামুন-অর-রশীদ দৈনিক আমার দেশ-কে জানান, গত এক বছরে ওই এলাকায় বড় ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি; বরং রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তারা ছিনতাই হওয়া একটি হোন্ডা উদ্ধার করেছেন। অফিসার ইনচার্জ আরও জানান, ওই এলাকায় সেদিন টহল পুলিশ নিয়ম অনুযায়ী রাত ৮টা থেকে রাস্তায় থাকার কথা। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফাউন্ডার প্রিন্সিপাল জানান, তার দেখা মতে, গত এক বছরে এমন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি।
তদন্তে নামেনি র্যাব-সিআইডি : প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলোচিত ইলিয়াস আলী গুমের মতো এমন একটি ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে র্যাব, সিআইডি ও বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দেখা যায়নি। এরচেয়ে কম গুরত্বপূর্ণ কোনো অপরাধ তদন্তে র্যাবকে জোরালো ভূমিকায় দেখা যায়। খুন-খারাবির ঘটনায় র্যাব সফলও হচ্ছে। অথচ ইলিয়াস আলীর মতো বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এমপিকে প্রকাশ্যে বাসার কাছাকাছি এলাকায় গাড়ি থেকে তুলে নেয়ার ঘটনায় র্যাবের জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি নেতা ও সহকর্মীদের অভিযোগ, ইলিয়াস আলীকে আটকের সিক্রেট এজেন্টদের টিমে র্যাব সদস্যরাও ছিল। সাদা পেশাকধারী র্যাব সদস্যরা তাকে ঢাকার আরেক বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনার ২১ মাস ধরে নিখোঁজ চৌধুরী আলমের মতো একই কায়দায় আটক করে গুম করেছে। যদি র্যাব সদস্যদের অভিযোগ সঠিক না হয় তাহলে ওই সংস্থার উচিত ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা। কেননা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট উপাদান র্যাবের কাছে রয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা উইং অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু ঘটনার রহস্য উন্মোচন ইতোপূর্বে হয়েছে। র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের কাছেই রয়েছে সরকারিভাবে কোটি টাকা খরচ করে ক্রয় করা এই হাইটেক যন্ত্রপাতি। এগুলো ব্যবহার করে সামান্য ঘটনা, চুরি, ডাকাতি, খুন ও অপহরণের আসামিদের অবস্থান নির্ণয় করে আসামি আটক ও রহস্য উন্মোচন করে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের বহু উদাহরণ রয়েছে। পারিবারিক সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও (নম্বর ০১৭৩২২৯৩৭৪৪
খোয়া যায়। সেটি পাওয়া যায়নি। সঙ্গে থাকা কোনো মালামালই পাওয়া যায়নি। চালক আনসার আলীর মোবাইল ফোনটি গাড়িতে পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি বিএনপি নেতার ফোনটি। আনসারের ফোনটি পুলিশের কাছে রয়েছে। ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোন সেটের জিপিএস ট্র্যাক করে সেটির বর্তমান অবস্থান এবং তাকে অপহরণের টিমে অংশগ্রহণকারীদের মোবাইল সেট ও সিম নম্বর জানা সম্ভব। এর আগে আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার তাপসের ওপর হামলার ঘটনায় যেমনটি করা হয়েছিল। বিটিআরসি’র কাছে বর্তমানে সে প্রযুক্তি রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিতভাবে বিটিআরসির সহযোগিতায় অনেক ছোট ঘটনার ক্ষেত্রেও মোবাইল সেটের জিপিএস ট্র্যাক করে অপরাধীদের শনাক্ত করে থাকে।
চালক আনসার ছিল বিশ্বস্ত : জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই আনসার আলী ইলিয়াস আলীর পরিবারে রয়েছেন। তিনি ছিলেন পরিবারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তাজুল ইসলাম নামে তাদের আরও একজন চালক রয়েছেন। তবে ইলিয়াস আলী অধিকাংশ সময়ই আনসার আলীকে নিয়ে বের হতেন। ঘটনার দিন রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে আনসার স্থানীয় বিএনপি নেতা পাপ্পুকে ফোন করে তার মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করতে বলেন। কিন্তু রাতে বাসার কাছাকাছি ফ্লেক্সিলোডের কোনো দোকান খোলা না থাকায় তিনি টাকা পাঠাতে পারেননি। পাপ্পু জানান, টাকা পাঠাতে না পেরে কিছুক্ষণ পর তার মোবাইলে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়। হয়তো ব্যাটারি চার্জ না থাকায় মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে ভেবে তখন সন্দেহ করেনি। এর কিছুক্ষণ পরই জানতে পারেন ইলিয়াস আলীর সঙ্গে আনসারকেও পাওয়া যাচ্ছে না। পারিবারিক সূত্র জানায়, ইলিয়াসের সঙ্গে থাকা আনসার ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বস্ত। এ কারণে তারও একই পরিণতি হয়েছে। অতীতেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় যৌথবাহিনীর সদস্যরা ইলিয়াস আলীকে আটক করে নেয়ার সময় আনসারকেও নির্যাতন চালিয়েছে। এবারও আনসারকে ছেড়ে দেয়া হলে ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে, তাই তাকেও গুম করা হয়েছে।
পুলিশ ফোন করার আগেই খবর পাওয়া যায় : ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর পুলিশ চালকের ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফোন করে। রাত পৌনে ১টার দিকে প্রথমে ইলিয়াস আলীর বড় ছেলের মোবাইল ফোনে সিলেটের সাহাবুদ্দিন ও এলান নামে দুই বিএনপি নেতা ফোন করেন। তারা জানান, আনসারের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে কিনা জানতে চান। রাতে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা ঘুমে থাকায় ছেলে মাকে এ কথা জানায়নি। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বনানী থানা থেকে এক পুলিশ ফোন করেন ইলিয়াস আলীর ছেলের ফোনে। সেই পুলিশ গাড়ির নম্বর উল্লেখ করে ঘটনা জানান। এরপর রাত দেড়টার দিকে এএসআই মাহবুবসহ ক’জন পুলিশও ফোন করে ঘটনা জানান। এরপরই বাড়ির লোকজন নানা স্থানে ফোন করে খোঁজ নিতে শুরু করে। বনানী থানার ওসিসহ ক’জন পুলিশ ইলিয়াস আলীর বাসায় যান। তারা জানান, রাস্তার মাঝে গাড়ি পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়। গাড়ির দরজা খোলা ছিল। ভেতরে পাওয়া মোবাইল ফোনের কললিস্ট থেকে বিভিন্নজনকে ফোন করে পুলিশ নিশ্চিত হয় গাড়িটি কার। রাতেই ইলিয়াসের বাসায় কান্নার রোল পড়ে। তবে বনানী থানা থেকে রাত সাড়ে ১২টায় ফোন করলেও পরবর্তীতে তারা জানায়, রাত ১টা ৩০ মিনিটে তারা গাড়িটি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে। পরিবারের অভিযোগ—পুলিশ শুরু থেকেই ঘটনাটি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে আসছে।
ছেলে গতকাল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল : গতকাল বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, বিকাল ২টার দিকে ইলিয়াস আলীর বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাসার নিচে বসে আছে। আবরার বলে, বাবার এমন ঘটনার পর আর মাথায় কিছু কাজ করছিল না। এরই মাঝে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। সে জানায়, বিভিন্ন মিডিয়ায় আমাদের এবং গাড়িচালক ও কেয়ারটেকারের বরাত দিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক কিছু বাড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে মিডিয়ায়। আবরার বলে, সঠিক তথ্য প্রচার করলে ভালো হতো। আবরার আরও বলে, সকালে তাকে নটর ডেম কলেজে পৌঁছে দিয়ে মা হাইকোর্টে যান।
গুমের ঘটনার ব্যাপারে গুলশান জোনের পুলিশের ডিসি খন্দকার লুত্ফুল কবীর বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি। পুলিশ জিডির সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তদন্তে কোনো ত্রুটি নেই। বিভিন্ন ব্যক্তিকে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কারও কাছ থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন তিনি। অপহরণ বা নিখোঁজের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত রয়েছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে পুলিশ সদস্যদের দিয়ে এমন কাজ কখনও হয়নি।
বনানীতে ইলিয়াস আলীকে যেভাবে অপহরণ করা হয় : মোবাইল ট্র্যাক করে অপহরণকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব
স্টাফ রিপোর্টার
মধ্যরাতে বনানীর নির্জন সড়ক থেকে বিএনপির জনপ্রিয় সাহসী নেতা এম ইলিয়াস আলীকে অপহরণ নিয়ে রহস্য ক্রমেই দানা বাঁধছে। র্যাব, সিআইডিসহ পুলিশের নীরব ভূমিকা শঙ্কাকুল করে তুলেছে সবাইকে। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ঘটনার পর গতকাল পর্যন্ত গোয়েন্দারা ঘটনাস্থল থেকে কোনো ধরনের আলামত সংগ্রহ করেনি। সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট সেখানে যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে আলামত যাতে নষ্ট হয়, সে জন্যই এই নীবরতা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলটি নির্জন। মধ্যরাতে লোক চলাচল খুবই কম।
পরিকল্পিতভাবেই অপহরণের জন্য ওই জায়গাটি বেছে নেয়া হয়। রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে ঘটে অপহরণ। প্রথমে সাদা পোশাকের একদল লোক ইলিয়াস আলীকে তার গাড়ি থেকে বের করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এ সময় ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনেছেন তারা। ড্রাইভার আনসারকে ওই সময় কিংবা কয়েক মিনিট পর তারা তুলে নেয়। দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শী এমন ধারণা দিয়েছেন যে, আনসারকে ধাওয়া করে অপহরণকারীরা ধরে ফেলে। তাদের বর্ণনায় এক্ষেত্রে নেয়া হয় বিশেষ কৌশল। ইলিয়াস আলীকে বহনকারী গাড়িটিকে গুম মিশনের লোকজন বহনকারী মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, যাতে ইলিয়াস গাড়িটি থামান। ইলিয়াসের প্রাইভেটকার থামতেই অপহরণকারীরা হুটহাট নেমে পড়ে ইলিয়াসকে জেরা করে মাইক্রোতে তুলে নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা গাড়ি ধাক্কার শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
এদিকে ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী কিশোর টোকাই রনি ঘটনার পর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর পুলিশি তত্পরতার কথা বললেও বাস্তবতা তার উল্টো।
পুলিশ ও গোয়েন্দারা নামকাওয়াস্তে কিছু খোঁজখবর করছে, যা নিতান্তই আইওয়াশ। সরকার ও গোয়েন্দারা চাইলে মোবাইল ট্র্যাক করেই অপহৃত ও অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারে। অথচ তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। র্যাব বিবৃতি দিয়ে দায় এড়িয়েই খালাস। তারা কোনো ধরনের অ্যাকশনে যায়নি। পুলিশের সিসিটিভি ক্যামেরায়ও অপহরণ দৃশ্য থাকার কথা, ট্রাফিক সিগন্যাল ও প্রতিটি মোড়েই সিসিটিভি রয়েছে। মহাখালী ফ্লাইওভার এলাকার সিসিটিভির মাধ্যমে ঘটনাস্থল কভার দেয়ার কথা। সেসব ফুটেজ মনিটর করলেই ওই সময় ওই রাস্তায় কোন গাড়ি চলাচল করেছে, তাতে যাত্রী কারা ছিল তা ধরা পড়ার কথা। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে গতকাল ঘটনাস্থল ঘুরে সরেজমিন তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে।
গতকাল সকাল ১১টার দিকে বনানীর সাউথ পয়েন্ট, ১ নম্বর রোড, ২ নম্বর ও ৪ নম্বর রোড, ২ নম্বর রোডের মসজিদ গলি, মহাখালী কাঁচা বাজার এলাকা, মহাখালী ফ্লাইওভার, এরশাদনগর বস্তি ও বনানী থানা এলাকায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে নানা তথ্য ।
বনানী দুই নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাপারেল গার্মেন্ট ভবনের ৯ তলার একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে তিনি আতঙ্কিত। পরদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় তিনি জানতে পারেন এ ঘটনায় একজন বিএনপি নেতা ও তার গাড়িচালক নিখোঁজ হয়েছেন। হয়রানির ভয়ে তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
এদিকে এ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থলের রাস্তার পূর্বপাশে অবস্থিত নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড লুত্ফরকে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ তাকে আটক করে গুলশান জোনের ডিসির কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ছেড়ে দেয়। লুত্ফরের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। সে জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে তার ডিউটি ছিল। নির্মাণাধীন ১৮ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাজ চলছিল। সেখানে একটি চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় গভীর রাতে ভবনের সামনের রাস্তায় বিকট গাড়ির শব্দে সে ভয় পেয়ে যায়। নিচে লোকজনের চিত্কার ও উচ্চ শব্দে কয়েকজন কথা বলছে। সে ভয়ে প্রথমে দূরে সরে যায়। পরে দেখতে পায় কয়েকজন লোক ধস্তাধস্তি করছে। কিছুক্ষণ পর দেখতে পায় একটি মাইক্রোবাসের সামনে পুলিশের দুটি গাড়ি। এ দৃশ্য দেখে সে ভয়ে বাইরের দিকে না তাকিয়ে ঘুমাতে যায়। ভয়ে সে এ ঘটনা আর কাউকে জানায়নি। তার ধারণা, কেউ হয়তো কাউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঝামেলা হতে পারে ভেবে বিষয়টি কাউকে জানাতে চায়নি। বেলা সাড়ে তিনটায় বনানী থানা থেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছেন। খোঁজ নেই তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক আনসারেরও। ইলিয়াস আলী মঙ্গলবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সিলভার রঙের যে গাড়ি নিয়ে বনানীর নিজ বাসা থেকে বের হন, ওই গাড়িটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার গভীর রাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গাড়িটি উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ।
ইলিয়াস সর্বশেষ ফোন করেন রূপসী বাংলা থেকে : বিডিনিউজ জানায়, বন্ধ হওয়ার আগে বাংলা মোটর, ইস্কাটন ও রূপসী বাংলা হোটেল (শেরাটন
এলাকায় এম ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করেছে র্যাব।
র্যাব আরও জানতে পেরেছে, মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে সিলেটের এক সাংবাদিকের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল সিলেট-২ আসনের এই সাবেক সংসদ সদস্যের।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানীর বাড়ি থেকে দুজন ব্যক্তির সঙ্গে ইলিয়াস আলীর গাড়িতে ওঠার তথ্য পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও তাদের নাম-ধাম কিছুই জানতে পারেনি র্যাব।
বুধবার প্রথম প্রহরে (রাত দেড়টার দিকে
মহাখালীর আমতলী সংলগ্ন একটি গলিতে ইলিয়াস আলীর গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে পাওয়া যায়নি ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসারকে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাত ১২টা ২ মিনিটে সিলেটের ওই সাংবাদিকের সঙ্গে ইলিয়াস আলীর সর্বশেষ কথা হয়। তখন ইলিয়াস আলীর মোবাইলের অবস্থান ছিল ইস্কাটন এলাকায়।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কিছু লেখালেখি করা যায় কি-না তা নিয়ে তাদের কথা হয়েছে বলে ওই সাংবাদিক র্যাবকে জানিয়েছেন, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই রাতে বাংলা মোটর, ইস্কাটন, শেরাটন হোটেল এলাকায় ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে।
ওই রাতে রূপসী বাংলা হোটেলে ইলিয়াস আলী গিয়েছিলেন এবং এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা ছাড়াও সিলেট বা ঢাকায় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পারিবারিক কোনো দ্বন্দ্ব এর মধ্যে ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাংবাদিকের আগে চালক আনসারের সঙ্গে মোবাইলে ইলিয়াসের কথা হয় বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, রাত দেড়টার দিকে আমতলীর গলিতে দরজা খোলা অবস্থায় ইলিয়াস আলীর গাড়িটি পড়ে ছিল। ইলিয়াসের বাড়ি ওই স্থানের কাছেই।
গাড়িতে চালক আনসারের মোবাইল ফোন পড়ে ছিল। এটি যে ইলিয়াসের গাড়ি, ওই মোবাইল থেকে কল করেই পুলিশ তা নিশ্চিত হয়।
ইলিয়াস আলীর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শফিকুর রহমান ও পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুজনকে সঙ্গী করে প্রাইভেটকারটি নিয়ে বের হন বিএনপি নেতা। গাড়ি চালাচ্ছিলেন আনসার। এই দুজন কারা ছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি বলে র্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব তথ্য দরকার, ইলিয়াস আলীর পরিবার বা তার দলের পক্ষ থেকে সে ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে তদন্তকাজ দ্রুত হতো।
কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে সরকার গুম করেছে বলে বিএনপির অভিযোগ। স্বামীর সন্ধান চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে রিট আবেদনেও তা বলেছেন ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সরাসরি বলেছেন, র্যাবের লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।
তবে র্যাব ও পুলিশ জানিয়েছে, ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইলিয়াস নিখোঁজের এ ঘটনা বিএনপির নাটক।
গুমের আগের ঘটনাগুলো : আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত যুবদলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে রূপসী বাংলা হোটেলে ছিলেন ইলিয়াস। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি বনানীর নিজ বাসার দিকে রওনা হন। গাড়ি থেকে উদ্ধার করা ফোনের কললিস্ট ধরে বিভিন্ন নম্বরে ফোন করে পুলিশ নিশ্চিত হয়, গাড়িটি ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর। মোবাইল ফোনের সেটটি ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসারের। এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি
করেছেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা।
লুনা বলেন, ছোট ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টায় আমি বাসায় ফিরি। এ সময় বাসার নিচে ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়। গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিল ইলিয়াস। বাসার নিচে দেখা হওয়ার পর ছেলের অসুখের ব্যাপারে চিকিত্সক কী বলেছেন তা আমার কাছে জানতে চায়। বাসার নিচে এ সময় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী সফু, যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলীসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। রাত দেড়টার দিকে বনানী থানা থেকে পুলিশ সদস্য পরিচয়ে আমার মোবাইলে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা হয়, ঢাকা মেট্রো-গ-২৯-৪৪১৫ নম্বরের গাড়িটি আমাদের কি-না। এরপর থানায় গিয়ে গাড়িটি শনাক্ত করি। তবে পুলিশ আমার স্বামীর খোঁজ দিতে পারেনি। স্বামীকে খুঁজে পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন লুনা।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী আরও বলেন, মঙ্গলবার রাতে যুবদল নেতা নেওয়াজকে নিয়ে একজন আইনজীবীর বাসায় যান ইলিয়াস। আইনজীবীর বাসা থেকে বের হওয়ার পর নেওয়াজকে রেখে বাসার উদ্দেশে রওনা হন ইলিয়াস। এরপর তার খোঁজ নেই। বন্ধ পাওয়া যায় ইলিয়াসের মোবাইল ফোন।
পৌনে ১২টা পর্যন্ত রূপসী বাংলায় ছিলেন ইলিয়াস : যুবদল নেতা নেওয়াজ জানান, রাত পৌনে ১০টার দিকে বনানীর বাসা থেকে ইলিয়াস ভাইয়ের গাড়িতে আমরা রূপসী বাংলা হোটেলে যাই। গাড়িতে চালক ছাড়াও যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমজাদ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। হোটেলের লবিতে বসে আইনজীবী আহসান হাবিবের জন্য অপেক্ষা করেন ইলিয়াস ভাই। কয়েক দফা ফোন করার পরও হাবিব আসেননি। পৌনে ১২টার দিকে রূপসী বাংলা হোটেলের বাইরের লবির আলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল। এ সময় ইলিয়াস ভাই আমাদের নিয়ে হোটেলের বাইরে এসে নিজ গাড়িতে উঠে বাসার দিকে রওনা হন। আমি আমার আজিমপুরের বাসায় ফিরে আসি। সকালে জানতে পারি, ইলিয়াস ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না।
যেভাবে শনাক্ত হয় গাড়ি ও মোবাইল : মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে বনানীর আমতলী ক্রসিং সংলগ্ন সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত
পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন টহল পুলিশের সদস্যরা। গাড়িটি দরজা খোলা অবস্থায় ছিল। গাড়ির ভেতরে একটি মোবাইল ফোনও পাওয়া যায়। টহল পুলিশ ওয়াকিটকিতে বিষয়টি বনানী থানা পুলিশকে জানায়। পরে উদ্ধার করা মোবাইলের কললিস্ট ধরে পুলিশ প্রথমে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদকে ফোন করে। তার কাছেই পুলিশ নিশ্চিত হয় মোবাইলটি ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসারের। গাড়ির মালিক ইলিয়াসের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার লুনা।
মাঠে দেখা যায়নি র্যাব-সিআইডিকে : এত বড় একটি ঘটনা তদন্তে র্যাব, সিআইডি কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো সদস্য ঘটনাস্থলে যায়নি। সাধারণত চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা র্যাব তদন্ত করে। কিন্তু এম ইলিয়াস আলী চালকসহ গুম হওয়ার মতো এমন আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা তদন্তে র্যাবকে দেখা যায়নি। যদিও ঘটনার পর থেকেই পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে গুমের ঘটনায় র্যাবকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তারা এ ঘটনা না ঘটালেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার কথা। কিন্তু অভিযোগের ইঙ্গিত দেয়া র্যাব সদস্যরা কেউ গতকাল ঘটনাস্থলে যায়নি। তবে সকাল থেকেই নতুন উদ্বোধন করা বনানী থানা পুলিশকে দেখা গেছে। পুলিশের ৭-৮ জনের একটি দল ঘটনাস্থলে বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড লুত্ফর ও মাসুদ রানাকে ছাড়াও ওই ভবনের ৬ জন নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেন। অপর সিকিউরিটি গার্ড মাসুদ রানা জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল তার। ১০টা থেকে বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল লুত্ফরের। মাসুদ রানার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। সে তিন মাস ধরে এখানে আছে। তবে নির্মাণ শ্রমিকরা এ বিষয়ে পুলিশকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এছাড়া সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পাঁচ সিকিউরিটি গার্ড ও একজন অফিস সহকারীকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সকালে স্কুলে গিয়ে পুলিশের দুটি টিম পৃথকভাবে জিজ্ঞাসা করে ইলিয়াস আলী নিখোঁজের বিষয়ে তারা কিছু জানে কি-না। কিন্তু তারা পুলিশকে জানিয়েছে, বিকাল সাড়ে তিনটায় স্কুল ছুটি হওয়ার পর সিকিউরিটি গার্ডরা ছুটি পায়। তারা স্কুলের ভেতরে নিচতলায় একটি কক্ষে থাকে। রাতে স্কুলের বাইরে তারা ডিউটি করে না। স্কুলের সামনের রাস্তায় ঘটনাটি ঘটলেও তারা কোনো শব্দ পায়নি বলে জানায়।
নির্জন এলাকা : ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে আমতলী যেতে বাঁদিকে বনানী দুই নম্বর সড়কে ঢুকেই সামান্য দূরে সাউথ পয়েন্ট স্কুল। তার একটু আগে রাস্তার পূর্বপাশে নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ার। এ ২ নম্বর সড়ক থেকে সামান্য দূরেই ২/১ নম্বরে সিলেট হাউস। ৬তলা ভবনের পাঁচ তলায় সপরিবারে থাকেন এম ইলিয়াস আলী। তিনি প্রতিদিনই এ সড়ক দিয়ে চলাফেরা করেন। তবে রাত ১০টার পরই রাস্তাটি নির্জন এলাকায় পরিণত হয়। মহাখালী সড়ক ব্যস্ত থাকলেও দুই নম্বর সড়কটির শুরু থেকে সাউথ পয়েন্ট স্কুল পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে আবাসিক ভবন বা দোকানপাট নেই। মহাখালী থেকে সড়কে ঢুকে সাউথ পয়েন্ট স্কুল পর্যন্ত যেতে পশ্চিম দিকটা একেবারেই খালি। পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন নূরানী টাওয়ার। সেখানেও পর্যায়ক্রমে একজন সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া কেউ থাকে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাটি ঘটেছে এ নির্জন এলাকাতেই। ইলিয়াস আলীর ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটিও পাওয়া গেছে ঠিক নুরানী টাওয়ারের সামনে। ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণকারী চক্রটি পরিকল্পিতভাবেই এ স্থানটি বেছে নিয়েছে। এলাকাটি নির্জন ও জনবসতিপূর্ণ না হওয়ায় ইলিয়াস আলীকে সেখানেই টার্গেট করা হয়। যেহেতু তিনি নিয়মিত এ রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করেন, তাই আগে থেকেই অপহরণকারীরা এখানে ওত পেতে ছিল। তারা ইলিয়াস আলীর গাড়িটি মহাখালী থেকে দুই নম্বর সড়কে ঢোকার পরই পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে পেছনের বাম্পার মাঝখান থেকে বাঁকা হয়ে যায়। বামপাশের ব্যাক লাইটও ভেঙে যায়। দাগ পড়ে যায় পেছনে। হয়তো ইলিয়াস আলীকে প্রাইভেট কার থেকে নামানোর কৌশল করতেই ধাক্কা দেয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে আসার পরই ইলিয়াস আলী ও তার চালক আনসার আলীকে অস্ত্রের মুখে আটক করে নিয়ে যায়। পরে গাড়িটি রাস্তায় দরজা খোলা অবস্থায় পায় পুলিশ। টহল পুলিশের এএসআই মাহবুব জানান, তিনি ওই রাতে গাড়িটি নূরানী টাওয়ারের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ঠেলে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে নিয়ে রাখেন। রাস্তায় যান চলাচলে বিঘ্ন না হয় সেজন্য তিনি গাড়িটি সরিয়ে রেখেছেন। পরে প্রাইভেট কারটি বনানী থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে আলামত হিসেবে গাড়িটি জব্দ করে বনানী থানার সামনে রাখা হয়েছে।
ড্রাইভার কি পালানোর চেষ্টা করেছিল : ইলিয়াস আলীকে অপহরণের মুহূর্তে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার আনসার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্তত দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের বাড়ি দেখাশোনা করে মো. জসিম। জসিম জানান, তিনি একা নন বিষয়টি অনেকেই দেখেছেন। স্কুলের সামনে কয়েকজন মিলে একজনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। দূর থেকে চিনতে না পারলেও সকালে সংবাদ শুনে সবাই সন্দেহ করেন ওই একজন ইলিয়াস আলীর গাড়ির চালক আনসার আলী। কারণ তারা সেখানে একজনকে সাদা মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ইলিয়াস আলীকে কি তার আগ মুহূর্তেই মাইক্রোবাসে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ইলিয়াস আলীকে বনানীর ২ নম্বর সড়কে অপহরণের মুহূর্তে তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে অপহরণকারীরা তাকে ধাওয়া করে সহজেই ধরে ফেলে এবং গাড়ির পেছন দিকে ধাক্কা দেয়। জসিম বলেছেন, যাদের সঙ্গে প্রাইভেট কারের আরোহীর ধস্তাধস্তি হয়েছে তারা সাদা পোশাকের লোকজন। জসিম নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীর রেফারেন্স টেনে জানালেন, ইলিয়াস আলীকে সাউথ পয়েন্ট থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে অপহরণ করা হয়েছে। জসিম কয়েকজন পথচারীর রেফারেন্স দিয়ে জানান, গাড়ির শব্দ শুনে বাইরে বের হলে পথচারীরা জানিয়েছে একজনকে গাড়ির মধ্য থেকে বের করে কে বা কারা অপহরণ করেছে। এ সময় ওই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে সাউথ পয়েন্টে ঢোকার চেষ্টা করলে ধাওয়া করে পেছন থেকে অন্য গাড়ি দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিলে শব্দ হয়। একই ঘটনার বর্ণনা দেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও দুটি ভবনের কয়েকজন।
বনানী ২ নম্বর রোডের মসজিদ গলির মমতা টেলিকমের ব্যবসায়ী জানান, রাত প্রায় ১২টার সময় ১৪ নম্বর বাড়ির নানা তাদের দোকানের কাছে এসে জানায়, এইমাত্র গাড়ি থেকে কারে যেন কয়েকজন লোক টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেছে। এ সময় তারা দৌড়ে গলির মাথায় গেলে শুধু গাড়ি পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় গাড়ির ইমার্জেন্সি লাইট এবং হেডলাইট জ্বলতে দেখেন তারা। ১৪ নম্বর বাড়ির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, তারা কিছু একটার শব্দ শুনে বের হন। আর বাড়ির সামনে মসজিদের গলিতে ৫-৬টা দোকান থাকায় প্রতিদিন প্রায় ১২টা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য থাকে। এ সময় পথচারী কয়েকজন তাদের বললে তারা বাইরে এসে প্রায় ২০০ গজ দূরে টেনেহিঁচড়ে নিতে দেখেছেন। তবে রাতের আধো আলো আধো অন্ধকারে স্পষ্ট করে কারও মুখ চিনতে পারেননি। এরশাদ নগর বস্তির টোকাই আবদুর রহমান (১৪
জানায়, ওই রাস্তা দিয়ে সে মহাখালী কাঁচাবাজারে আলম ঠিকাদারের কাছ থেকে ফেরার সময় শুধু গাড়িটাকে পড়ে থাকতে দেখে। এ সময় গাড়ির সব আলো জ্বলছিল। গাড়িতে কেউ ছিল না। এমনকি প্রতিদিন এ সময় দোকান খোলা থাকলেও সেদিন খোলা ছিল না। রাস্তা ছিল নীরব-নির্জন।
একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী রনির হদিস নেই : অপহরণের ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছিল টোকাই রনি। কিন্তু গতকাল কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি রনিকে। সেদিন রাতে রনি সাউথ পয়েন্টের ডাবের খোসা সরানোর কাজ করছিল। স্কুলের সামনে খোলা মাঠের ভিতরের অংশে ফুটপাত ঘেঁষে কয়েকজন ডাব বিক্রেতা খোসা ফেলে রেখে যায়। যা রনি একদিন পর পর রাতে তুলে নেয়। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে রনি খোসা তুলতে আসে বলে জানায় টোকাই আবদুর রহমান, শাওন ও রহিম। একই প্রসঙ্গে ডাব বিক্রেতারা সত্যতা স্বীকার করে জানান, ওই রনি ডাবের খোসা তুলে নিয়েছিল এবং রনি কাজটা ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকেই করে বলে জানায় এক ডাব বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম। রনি সকাল-বিকাল মহাখালী কাঁচাবাজারের ডাস্টবিন থেকে ভাঙাড়ি কুড়ায়এমন তথ্যে সেখানে গেলে অন্য কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও রনিকে পাওয়া যায়নি। ভাঙাড়ি কুড়ানো কয়েকজন জানায়, রনি ওই ঘটনা দেখেছে বলে জানিয়েছে। বেলতলা এরশাদনগর বস্তিতে খুঁজলেও রনিকে পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : টহল পুলিশের এএসআই মাহবুব রহমান জানান, তার টহল এ এলাকায় ছিল না। মহাখালী কাঁচাবাজারে টহল শেষে ফেরার পথে গাড়িটি আলোবিহীন পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে জানান দৈনিক আমার দেশ-কে। বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মামুন-অর-রশীদ দৈনিক আমার দেশ-কে জানান, গত এক বছরে ওই এলাকায় বড় ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি; বরং রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তারা ছিনতাই হওয়া একটি হোন্ডা উদ্ধার করেছেন। অফিসার ইনচার্জ আরও জানান, ওই এলাকায় সেদিন টহল পুলিশ নিয়ম অনুযায়ী রাত ৮টা থেকে রাস্তায় থাকার কথা। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফাউন্ডার প্রিন্সিপাল জানান, তার দেখা মতে, গত এক বছরে এমন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি।
তদন্তে নামেনি র্যাব-সিআইডি : প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলোচিত ইলিয়াস আলী গুমের মতো এমন একটি ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে র্যাব, সিআইডি ও বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দেখা যায়নি। এরচেয়ে কম গুরত্বপূর্ণ কোনো অপরাধ তদন্তে র্যাবকে জোরালো ভূমিকায় দেখা যায়। খুন-খারাবির ঘটনায় র্যাব সফলও হচ্ছে। অথচ ইলিয়াস আলীর মতো বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এমপিকে প্রকাশ্যে বাসার কাছাকাছি এলাকায় গাড়ি থেকে তুলে নেয়ার ঘটনায় র্যাবের জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি নেতা ও সহকর্মীদের অভিযোগ, ইলিয়াস আলীকে আটকের সিক্রেট এজেন্টদের টিমে র্যাব সদস্যরাও ছিল। সাদা পেশাকধারী র্যাব সদস্যরা তাকে ঢাকার আরেক বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনার ২১ মাস ধরে নিখোঁজ চৌধুরী আলমের মতো একই কায়দায় আটক করে গুম করেছে। যদি র্যাব সদস্যদের অভিযোগ সঠিক না হয় তাহলে ওই সংস্থার উচিত ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা। কেননা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট উপাদান র্যাবের কাছে রয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা উইং অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু ঘটনার রহস্য উন্মোচন ইতোপূর্বে হয়েছে। র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের কাছেই রয়েছে সরকারিভাবে কোটি টাকা খরচ করে ক্রয় করা এই হাইটেক যন্ত্রপাতি। এগুলো ব্যবহার করে সামান্য ঘটনা, চুরি, ডাকাতি, খুন ও অপহরণের আসামিদের অবস্থান নির্ণয় করে আসামি আটক ও রহস্য উন্মোচন করে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের বহু উদাহরণ রয়েছে। পারিবারিক সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও (নম্বর ০১৭৩২২৯৩৭৪৪
খোয়া যায়। সেটি পাওয়া যায়নি। সঙ্গে থাকা কোনো মালামালই পাওয়া যায়নি। চালক আনসার আলীর মোবাইল ফোনটি গাড়িতে পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি বিএনপি নেতার ফোনটি। আনসারের ফোনটি পুলিশের কাছে রয়েছে। ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোন সেটের জিপিএস ট্র্যাক করে সেটির বর্তমান অবস্থান এবং তাকে অপহরণের টিমে অংশগ্রহণকারীদের মোবাইল সেট ও সিম নম্বর জানা সম্ভব। এর আগে আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার তাপসের ওপর হামলার ঘটনায় যেমনটি করা হয়েছিল। বিটিআরসির কাছে বর্তমানে সে প্রযুক্তি রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিতভাবে বিটিআরসির সহযোগিতায় অনেক ছোট ঘটনার ক্ষেত্রেও মোবাইল সেটের জিপিএস ট্র্যাক করে অপরাধীদের শনাক্ত করে থাকে।
চালক আনসার ছিল বিশ্বস্ত : জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই আনসার আলী ইলিয়াস আলীর পরিবারে রয়েছেন। তিনি ছিলেন পরিবারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তাজুল ইসলাম নামে তাদের আরও একজন চালক রয়েছেন। তবে ইলিয়াস আলী অধিকাংশ সময়ই আনসার আলীকে নিয়ে বের হতেন। ঘটনার দিন রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে আনসার স্থানীয় বিএনপি নেতা পাপ্পুকে ফোন করে তার মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করতে বলেন। কিন্তু রাতে বাসার কাছাকাছি ফ্লেক্সিলোডের কোনো দোকান খোলা না থাকায় তিনি টাকা পাঠাতে পারেননি। পাপ্পু জানান, টাকা পাঠাতে না পেরে কিছুক্ষণ পর তার মোবাইলে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়। হয়তো ব্যাটারি চার্জ না থাকায় মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে ভেবে তখন সন্দেহ করেনি। এর কিছুক্ষণ পরই জানতে পারেন ইলিয়াস আলীর সঙ্গে আনসারকেও পাওয়া যাচ্ছে না। পারিবারিক সূত্র জানায়, ইলিয়াসের সঙ্গে থাকা আনসার ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বস্ত। এ কারণে তারও একই পরিণতি হয়েছে। অতীতেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় যৌথবাহিনীর সদস্যরা ইলিয়াস আলীকে আটক করে নেয়ার সময় আনসারকেও নির্যাতন চালিয়েছে। এবারও আনসারকে ছেড়ে দেয়া হলে ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে, তাই তাকেও গুম করা হয়েছে।
পুলিশ ফোন করার আগেই খবর পাওয়া যায় : ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর পুলিশ চালকের ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফোন করে। রাত পৌনে ১টার দিকে প্রথমে ইলিয়াস আলীর বড় ছেলের মোবাইল ফোনে সিলেটের সাহাবুদ্দিন ও এলান নামে দুই বিএনপি নেতা ফোন করেন। তারা জানান, আনসারের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে কিনা জানতে চান। রাতে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা ঘুমে থাকায় ছেলে মাকে এ কথা জানায়নি। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বনানী থানা থেকে এক পুলিশ ফোন করেন ইলিয়াস আলীর ছেলের ফোনে। সেই পুলিশ গাড়ির নম্বর উল্লেখ করে ঘটনা জানান। এরপর রাত দেড়টার দিকে এএসআই মাহবুবসহ কজন পুলিশও ফোন করে ঘটনা জানান। এরপরই বাড়ির লোকজন নানা স্থানে ফোন করে খোঁজ নিতে শুরু করে। বনানী থানার ওসিসহ কজন পুলিশ ইলিয়াস আলীর বাসায় যান। তারা জানান, রাস্তার মাঝে গাড়ি পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়। গাড়ির দরজা খোলা ছিল। ভেতরে পাওয়া মোবাইল ফোনের কললিস্ট থেকে বিভিন্নজনকে ফোন করে পুলিশ নিশ্চিত হয় গাড়িটি কার। রাতেই ইলিয়াসের বাসায় কান্নার রোল পড়ে। তবে বনানী থানা থেকে রাত সাড়ে ১২টায় ফোন করলেও পরবর্তীতে তারা জানায়, রাত ১টা ৩০ মিনিটে তারা গাড়িটি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে। পরিবারের অভিযোগপুলিশ শুরু থেকেই ঘটনাটি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে আসছে।
ছেলে গতকাল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল : গতকাল বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, বিকাল ২টার দিকে ইলিয়াস আলীর বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাসার নিচে বসে আছে। আবরার বলে, বাবার এমন ঘটনার পর আর মাথায় কিছু কাজ করছিল না। এরই মাঝে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। সে জানায়, বিভিন্ন মিডিয়ায় আমাদের এবং গাড়িচালক ও কেয়ারটেকারের বরাত দিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক কিছু বাড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে মিডিয়ায়। আবরার বলে, সঠিক তথ্য প্রচার করলে ভালো হতো। আবরার আরও বলে, সকালে তাকে নটর ডেম কলেজে পৌঁছে দিয়ে মা হাইকোর্টে যান।
গুমের ঘটনার ব্যাপারে গুলশান জোনের পুলিশের ডিসি খন্দকার লুত্ফুল কবীর বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি। পুলিশ জিডির সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তদন্তে কোনো ত্রুটি নেই। বিভিন্ন ব্যক্তিকে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কারও কাছ থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন তিনি। অপহরণ বা নিখোঁজের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত রয়েছেএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে পুলিশ সদস্যদের দিয়ে এমন কাজ কখনও হয়নি।