No actually this may be a reason -
বিপর্যয় আসবে বাংলাদেশে
ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প
The Daily Ittefaq - July 22, 2015
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদ-নদীসমূহের পানি ১৩টি সংযোগ খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা হলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ ও জনজীবন হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর উল্লেখ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে জানান, এ বিষয়ে ভারতকে চিঠি (নোট ভার্বাল) দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র থেকে গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তাই এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকতে ভারতকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি, ভারতের পত্র-পত্রিকায় নদী সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভারতকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
যদিও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে যে, আন্তঃদেশীয় নদীসমূহে তারা এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। এমনকি গত জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে এসেও স্পষ্ট করে বলেছেন যে ভারত অভিন্ন নদীসমূহে এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। বাংলাদেশকে যুক্ত রেখেই তারা সব সিদ্ধান্ত নেবে।
এ প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন ইত্তেফাককে জানান, ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি স্থানান্তর করে গঙ্গা অববাহিকায় দেয়া হলে সেটি যে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে তা জেআরসিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে ভারতকে জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয় এমন কিছু কখনোই করা হবে না বলে ভারতের পক্ষ থেকেও বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ভারত সরকার যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি তুলে ধরে ভারতকে নোট ভার্বাল পাঠানোর কথা জানানো হয়েছে।
ভারতজুড়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসাবে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের ‘তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সংকোষ’ নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে গত ১৩ জুলাই ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। এদিকে দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোষ-তিস্তা-গঙ্গা’র কাজ শুরু করবে। এ সময় পানিসম্পদ মন্ত্রী আরো বলেছেন, এ সংযোগ প্রকল্প শুধু এ অঞ্চলের কৃষি ও পানির প্রাপ্যতাকেই সহজ করে তুলবে না; একইসঙ্গে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিশাল পরিমাণ পানি সরবরাহ করবে।
উল্লেখ্য, ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভলপমেন্ট এজেন্সি প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৩০টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার বিশেষ দিক হচ্ছে নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে স্থানান্তর করা। এর মধ্যে ১৮টি নদী হিমালয় অঞ্চলের এবং ২০ পেনিনসুলার। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সারাদেশে ৭৪টি জলাধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। এর মাধ্যমে তারা আড়াই কোটি হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনবে আর জলবিদ্যুত্ উত্পন্ন করবে। এরই মধ্যে তারা ১১টি সংযোগ খালের সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে।
এদিকে, দেশের নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পানি আইন ও গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী উজানের দেশ ভারত আন্তঃদেশীয় নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। এমনকি যে কোন ধরনের কার্যক্রম হাতে নিতে হলেও দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী তাদের বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে তা করতে হবে।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির প্রস্তাবনার তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি ও এসব নদীতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে দেখা হবে। চুক্তির নয় নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দুই দেশের সরকার ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও কারো ক্ষতি করা নয়—এসব নীতিমালার আলোকে যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগি করতে সম্মত আছে। সুতরাং এই চুক্তির আওতায় ভারত কোনভাবেই একতরফাভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না।
বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশ কার্যত মরুভূমিতে পরিণত হবে। মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের শাখা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ আশংকাজনক হারে কমে যাবে। আর জলাভূমিগুলোও শুকিয়ে যাবে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে গেলে লবণাক্ততা দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত উঠে আসতে পারে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তারা এও বলছেন, ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ অংশ (যেখানে ধান ও গমের মোট উত্পাদনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে) পানির অভাবে নিষ্ফলা হয়ে যাবে। গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। এ সংযোগ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়বে। যার প্রভাবে নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, মত্স্য, পশুসম্পদ, শিল্প-কারখানা বিপর্যস্ত হবে। পাশাপাশি আর্সেনিক দূষণ তীব্র হবে, নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে নৌচলাচল ব্যাহত হবে, ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ নেমে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।
এ প্রসঙ্গে ওয়ারপো’র (ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন) সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী এম এ কাসেম বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ভারত একতরফাভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। কারণ ভাটির দেশ হিসাবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে কিনা তা সমীক্ষা না চালিয়েই তারা এটা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। যা দুই দেশের বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী আইনের লংঘন।
এদিকে, ওয়ারপোর সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় এমন বেশ কিছু নদীতেই সংযোগ খাল স্থাপন করে পানি প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা রয়েছে এ প্রকল্পে। ইতোমধ্যেই তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের সংযোগ খালের কাজও অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়েছে।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প
হিমালয় অববাহিকার নদীগুলোর ক্ষেত্রে যে ১৩টি সংযোগগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো: ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা (তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সংকোষ) সংযোগ, কোশি-মেচি, কোশি-ঘাঘড়া, গন্ধক-গঙ্গা, গঙ্গা-যমুনা, সারদা-যমুনা, যমুনা-পশ্চিম যমুনা খাল (রাজস্থান) খালের শীর্ষ শাখা, শবরমাটি সংযোগ পর্যন্ত রাজস্থান খালের সম্প্রসারণ, চুনার-সোন বাঁধ সংযোগ, সোন বাঁধ-গঙ্গা গঙ্গা সংযোগের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপনদী, গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা সংযোগ, ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ ও ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা (জেটিএফ) সংযোগ। সবক’টি সংযোগ খালই হিমালয় আববাহিকায় অবস্থিত।
১৯৮০ সালে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় পানি পরিকল্পনার কাজে হাত দেয়। সেই পরিকল্পনার আলোকে ২০০২ সালের ১৪ আগস্ট দেশটির তত্কালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম সংযোগ খাল তৈরি করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের নদীগুলোকে জুড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। ভারত সরকার প্রকল্পের ব্যয় ধরে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপি বা ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০০৪ সালে দুই দেশের পরিবেশবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে পড়ে। যদিও ভারত এরই মধ্যে তার নিজস্ব নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ করে ওই পরিকল্পনার কিছু কিছু অংশ বাস্তবায়ন করে চলেছে।
-------------------------------------------------------------------
‘মরুভূমি হবে বাংলাদেশ’
MTnews24.com - July 23, 2015
ভারতের ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ নিয়ে ব্যাখা চেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারতের এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশকে গভীর উদ্বেগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি ‘নোট ভারবাল’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরই প্রকল্পটি নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হলো। এদিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোন প্রকল্প তারা নেবেন না। বিশেষ করে ‘বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প’ এবং ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ করার আগে তারা বাংলাদেশের অনুমতি নেবে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়ায় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প শুরু করা নিয়ে যে সংবাদ প্রচার হয়েছে; তা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের নিজস্ব ব্যাপার হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদী প্রবহমান। তাই এ প্রজেক্টের কারণে বাংলাদেশ চরম পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। তারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। আর সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম বলেছেন, ভারতের এমন সর্বনাশা প্রকল্প বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করবে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এ ধরনের প্রকল্প বন্ধে ভারত সরকারকে চাপে রাখা।
গত ১৩ জুলাই ভারতীয় মিডিয়ায় ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ সংক্রান্ত সংবাদটি প্রকাশ পায়। সেখানকার মিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, আসাম-পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার রাজ্যের ‘তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সংকোষ’ নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ সহসাই শুরু হতে যাচ্ছে। দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট একথা বলেন। তিনি বলেন, তার মন্ত্রণালয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোষ-তিস্তা-গঙ্গা’ নদীর কাজ শুরু করবে।
এ সময় পানিসম্পদ মন্ত্রী আরো বলেন, এ সংযোগ প্রকল্প শুধু এ অঞ্চলের কৃষি ও পানি প্রাপ্যতাকেই সহজ করে তুলবে না, একইসঙ্গে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিশাল পরিমাণ পানি চালান করবে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, নদী সংযোগ প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে আমরা চিঠি পাঠিয়েছি। আমরা ভারতের কাছে জানতে চেয়েছি তারা এ ধরনের প্রকল্পের কাজ শুরু করছেন কি না? তিনি আরো বলেন, ভারত বারবার আশ্বাস দিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোন পরিকল্পনা তারা করবে না।
তা ছাড়া, গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কোন নদীতে এ ধরনের মহাপরিকল্পনা নিলে তা বাংলাদেশকে জানিয়ে করতে হবে।এদিকে যৌথ নদী কমিশনের একাধিক বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে যে, বাংলাদেশ আন্তঃবেসিন পানি ট্রান্সফারের বিপক্ষে। বাংলাদেশ কোনভাবেই চায়না ব্রহ্মপুত্রের পানি গঙ্গায় নেয়া হোক। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন প্রতিবেদককে জানান, জেআরসির বৈঠক বসলে আমরা এ বিষয়গুলো জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারতাম। এরপরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের সংবাদের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। তার মতে, গত ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি ভারতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের কারিগরি কমিটির বৈঠকেও আমরা যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের ওপর গুরুত্বারোপ করেছি।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে যৌথ নদী কমিশনৈর বৈঠক বন্ধ রয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের মার্চে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর উভয় দেশের মধ্যে আর কোন বৈঠক বসেনি। এ নিয়ে দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করা হলেও দিল্লীর আপত্তির কারণে তা স্থগিত করা হয়। জেআরসি’র বৈঠক না হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত নদী নিয়ে অনেক সমস্যা ঝুলে রয়েছে।উল্লেখ্য, ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ২৯টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার বিশেষ দিক হচ্ছে নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে স্থানান্তর করা। এই ২৯টি সংযোগ খালের মধ্যে ১৩টি হিমালয় বাহিত আর ১৬টি পেনিনসুলার বা বিভিন্ন নদী ও উপদ্বীপ থেকে উৎসারিত।
এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সারাদেশে ৭৪টি পানিধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। ফলে বর্ষার সময় সঞ্চিত পানি শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহ করা হবে। তারই অংশ হিসেবে এ নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী।শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করতে ভারত শুধু গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি; বাংলাদেশে পরিবেশগত বিপর্যয ডেকে আনতে আরও ছয়টি নদীর উজানে তারা বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ ছাড়াও মনু নদীতে নলকাঁথা বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানি বাঁধ ত্রবং মহুরি নদীর উপর ভারত কলসি বাঁধ নির্মাণ করেছে।
এছাড়াও তিস্তার পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা আন্তঃনদীসংযোগ মহাপরিকল্পনায় তিস্তাকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। ভারতের এই ম্যাগা পরিকল্পনায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানিকে গঙ্গায় ফেলতে তিস্তা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এ জন্য তিস্তাকে ঘিরেই ভারতের নানামুখী পরিকল্পনা।ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে গঙ্গায় এবং গঙ্গার পানিকে ভারতের খরাপীড়িত অঞ্চলে সরিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনাটি নতুন নয়। ভারতের এই আন্তঃনদী সংযোগ মহাপরিকল্পনা সূত্রপাত ১৯৫৪ সালে। ওইসময় কর্নেল দস্তর ব্রহ্মপুত্রের পানিকে সরিয়ে নিতে ভারতের উত্তরাঞ্চলে অর্ধচন্দ্রের মত একটি বিশাল খাল খননের প্রস্তাব তুলে ধরেন। এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তা গ্রহণ করেননি। এরপর ১৯৭০ সালে ভারতের সাবেক মন্ত্রী এল কে রাও সংযোগ খালের প্রস্তাব পেশ করেন।
১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে ভারতের পর থেকে বাংলাদেশের কাছে এই প্রস্তাবনাটি উত্থাপন করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই মর্মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান যে, কলকাতা বন্দরের চাহিদা এবং বাংলাদেশের চাহিদা এই উভয় চাহিদা মেটানোর মত পর্যাপ্ত পানি গঙ্গা নদীতে নেই। তাই এই চাহিদা মেটানোর জন্য গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। কিভাবে এই পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা যাবে এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন তুললে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭০ সালে গৃহীত এল কে রাও’র সংযোগ খালের মহাপরিকল্পনাটি তুলে ধরেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়-বাংলাদেশে রংপুর-দিনাজপুর জেলার বুকচিরে একটি বিশাল খাল কাটা হবে। এই খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানিকে রংপুর ও দিনাজপুরের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গায় ফেলা হবে। সেখান থেকে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে ফারাক্কায় সংরক্ষণ করা হবে।
এই পানি আনতে আসামের যোগীগোপায় ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে একটি বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানিকে গঙ্গায় নেয়ার জন্য ২০০ মাইল লম্বা একটি খাল কাটার প্রস্তাবও দেয়া হয়। এই খালটির প্রস্থ ধরা হয়েছিল আধা মাইল এবং গভীরতা ধরা হয়েছিল ৩০ ফুট। এরপর এই পানিকে খাল কেটে উড়িষ্যার সুবর্ণরেখা ও মহান্দী পর্যন্ত নেয়ার পরিকল্পনা আঁটা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবাস্তবায়নে ভারতের কাছে তিস্তা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু এই ভয়াবহ পরিকল্পনাটির মর্মার্থ বুঝতে পেরে সাথে সাথেই তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে এই প্রস্তাবনার সাথে ওই সময় ফারাক্কা ফিডার ক্যানেলের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালুর অনুমতি ভারত চাইলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে কোন কারণেই হোক তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যার খেসারত প্রতিটি শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমেই বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে।-ইনকিলাব
------------------------------------------------------------------------------------------
This may also be of interest -
বাধা ভারতের স্বার্থ
চীনের লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব ঝুলছে
Kaler Kantha - July 23, 2015
২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের করে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নেওয়ার স্বপ্ন রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। কাঙ্ক্ষিত সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হাতে সময় আর মাত্র তিন বছর। এ সময়ে কমাতে হবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য; বাড়াতে হবে প্রবৃদ্ধি। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য দরকার অবকাঠামো উন্নয়ন। আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে প্রতিবছর অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হতে হবে ৬০০ কোটি ডলার। অভ্যন্তরীণ সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারের পক্ষে প্রতিবছর এই অর্থ জোগান দেওয়া অসম্ভব। তবে আশার কথা হলো, সড়ক, রেলপথ, গভীর সমুদ্রবন্দর, টানেল, জাহাজ কেনা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করার লক্ষ্যে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন। কিন্তু আড়াই বছর ধরে ঝুলে আছে ডজনখানেক অবকাঠামো প্রকল্পে দেশটির ঋণ প্রস্তাব। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, এর পেছনে মূল কারণ প্রতিবেশী একটি বৃহৎ দেশের সঙ্গে চীনের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ও আন্তমন্ত্রণালয় দ্বন্দ্ব।
জানা যায়, বাংলাদেশে এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব রয়েছে চীনের, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চীনের নীতিনির্ধারকরা পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করতে চান। নিজেদের ইচ্ছা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে চীন। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণমূলক মনোভাব, বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব কমে যাওয়ার আশঙ্কাসহ অন্তত পাঁচ কারণে সেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব কাজে লাগাতে পারছে না সরকার। এসব কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে গত আড়াই বছরে চীনের সঙ্গে কোনো ঋণচুক্তি সই হয়নি। ওই বছর সর্বশেষ পদ্মা জশলদিয়া প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল সরকার।
চীনের দেওয়া প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব নিয়ে অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে পাঁচটি কারণ জানা গেছে। প্রথমত দেশের অভ্যন্তরে মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রভাবশালীদের মধ্যে রেষারেষি; দ্বিতীয়ত দেশে চীনের আধিপত্য বেড়ে যাওয়া এবং ভারতের প্রভাব কমে যাওয়ার আশঙ্কা; তৃতীয়ত চীনের দেওয়া ঋণের শর্ত; চতুর্থত প্রকল্প প্রণয়নে মন্ত্রণালয়গুলোর অদক্ষতা ও বিলম্ব এবং পঞ্চমত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে করা তিন বছর মেয়াদি বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ) শর্তের বেড়াজাল। এসব কারণে চীনের বড় আকারের ঋণ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না সরকার। অথচ সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং পাকিস্তান সফরে গিয়ে চার হাজার ৬০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করেছেন।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, চীনের অর্থায়নে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হলে এ দেশে ভারতের আধিপত্য কমে যাবে। বেড়ে যাবে চীনের প্রভাব। এটা কখনই মেনে নেবে না ভারত। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ ধারণা থেকেই গত বছর জুনে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়ে চীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। এখন পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চীনের এত বিশাল অর্থলগ্নি কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। মন্ত্রণালয় চায়, অর্থের নিয়ন্ত্রণ তারাই করতে। সংসদীয় কমিটি কিংবা সংস্থার সদস্যরা তাঁদের আধিপত্য ধরে রাখতে চান। আগে মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, এখন নেই, এমন অনেকেই আছেন যাঁরা চীনের বিনিয়োগ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চতুর্মুখী জটিলতার কারণে সরকার চীনের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আগের মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর চীনের অর্থায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি জাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল। ২১ বছর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে নতুন কোনো জাহাজ যোগ হয়নি। জাহাজ স্বল্পতার কারণে ক্রমাগত রুগ্ণ হয়ে পড়ছে বিএসসি। এমন বাস্তবতায় জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির রেষারেষির কারণে গত পাঁচ বছরে জাহাজ কেনার উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
সব মন্ত্রণালয়ের তথ্য এক জায়গায় সংরক্ষণের জন্য একটি ডাটা সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বছর তিনেক আগে। সে জন্য চীনের অর্থায়নে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে 'টায়ার-ফোর' শিরোনামের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চলতি বছরের শুরুতে চীন সরকারের সঙ্গে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কারণে সেই চুক্তি আর করা হয়নি। ওই মন্ত্রীর দাবি, এ প্রকল্পের সঙ্গে তাঁকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে।
রাজধানীর যানজট কমাতে ঢাকা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার উড়াল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য পরের বছর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এর সাফল্য শুধু ফলক উন্মোচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দীর্ঘদিন সিদ্ধান্তহীনতায় থাকার পর সরকার নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সেতু পিপিপির মাধ্যমে না করে সরকারি পর্যায়ে (জি টু জি) বাস্তবায়ন করবে। এখন চলছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসির সঙ্গে দরকষাকষি। এখানেও চলছে নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রতিযোগিতা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের প্রভাব কমে যাওয়ার অশঙ্কা, মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি চীনের দেওয়া কঠিন শর্তও কাজ না এগোনোর অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বহুজাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর ঋণের সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত। পরামর্শক নিয়োগসহ কিছু ক্ষেত্রে শর্ত থাকলেও বহুজাতিক সংস্থার ঋণ দিয়ে নিজের পছন্দমতো পণ্য ও সেবা যেকোনো দেশ থেকে কেনার সুযোগ থাকে ঋণগ্রহীতার। তবে এসব সংস্থার ঋণপ্রক্রিয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ও জটিল। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। নানা ছুতোয় মাঝপথে অবকাঠামো প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর নজিরও রয়েছে। অন্যদিকে চীন সরকার ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে পণ্য, সেবা কিংবা উপকরণ তাদের দেশ থেকে কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চীনের দেওয়া শর্ত নিয়ে এখন চলছে দরকষাকষি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আসিফ উজ জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চীন সরকার ২ শতাংশ সুদে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি পণ্য ও সেবা তাদের দেশ থেকেই আনার শর্ত দেওয়া হয়েছে। আমরা ঋণের সুদের হার দেড় শতাংশে নামিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত চিঠির জবাব পাওয়া যায়নি।'
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল সরকার। বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) নামের ওই ঋণের মেয়াদ ছিল তিন বছর। ওই ঋণের আর এক কিস্তি দেওয়া বাকি আছে। ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আগে সরকারকে ১৯টি শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ, যার একটি ছিল, অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সে ঋণে অনুদানের পরিমাণ থাকতে হবে ৩৫ শতাংশের বেশি। সুদের হার, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা, গ্রেস পিরিয়ডের হিসাব ধরে অনুদানের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। আইএমএফের মতে, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার ঋণে অনুদানের পরিমাণ থাকে ৫০ শতাংশের বেশি। আর চীনের ঋণে অনুদান থাকে ৩৫ শতাংশের কম, সেটি ২২ শতাংশ। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে এত দিন চীনের ঋণপ্রস্তাব নিয়ে তেমন এগোনো যায়নি।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আসিফ উজ জামান জানান, আইএমএফের ইসিএফের মেয়াদ শেষ। ফলে তাদের শর্তেরও কার্যকারিতা আর নেই। চীন থেকে ঋণ নিতে এখন আর বাধা নেই।
তবে চীন সরকার যেসব প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে, সেসব প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে সমীক্ষা ও নকশা করতে যে ধরনের দক্ষতা ও সক্ষমতা থাকা দরকার, তা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নেই বলে মনে করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইআরডি সূত্রে জানা যায়, চীন সরকার যেসব প্রকল্পে এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে, তার মধ্যে রেলওয়ের সবচেয়ে বেশি। সেসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগসহ ঢাকা থেকে মাওয়া এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল সংযোগ। এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশটি ২৬০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে চট্টগ্রাম থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে এখনো জমি অধিগ্রহণের কাজই শেষ হয়নি। এ প্রকল্পেও চীন সরকার অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩২০ কিলোমিটার। এই পথ অনেক ঘুরে গেছে। ঢাকা থেকে সরাসরি লাকসাম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করতে পারলে ঢাকা-চট্টগ্রাম দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে। সে জন্য চীন সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম কর্ডলাইন নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত দ্বৈত রেললাইন, জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ মিটার গেজ রেললাইনের পাশাপাশি সমান্তরাল আরেকটি ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা-আশুলিয়া ৩৮ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রায় ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চায় চীন। পাশাপাশি সরকারি পাটকল আধুনিকায়নে ২৮ কোটি ডলার, পাওয়ার গ্রিড কম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিবি) আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ডিজিটাল কানেকটিভিটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) শক্তিশালীকরণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ (আর্থিক চুক্তি বাকি), ছয়টি জাহাজ ক্রয় এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি অ্যান্ড সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পেও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। এসব প্রকল্পের জন্য দুই সরকারের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক চুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করেছে চীন সরকার। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।