মূলধারা বাংলাদেশ
ভারতকে বুঝা-৭ঃ ভারত-বাংলাদেশ সেনাবাহিনী'র 'সম্প্রীতি' ও সংকট
দেশরক্ষায় নিয়োজিত প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরতদের প্রধানত দুটো মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তাড়িয়ে বেড়ায়। এক. স্বদেশপ্রেম এবং দুই. শত্রুর প্রতি ঘৃণা। এই দুটো বিষয়ে একজন সৈনিককে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। সৈন্যরা কেন শত্রুকে খুনের ব্যাপারে একটুও বিচলিত হয়না? কারণ এই দুইটি বিষয়।সে মনে করে আমি আমার দেশকে রক্ষা করছি এবং সেটা করতে শত্রুকে শেষ করতেই হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে শত্রু মিত্রু নির্ধারনটা কে করে এবং কিভাবে করে? আন্তর্জাতিকভাবে সিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে আন্তর্জাতিক সীমান্তকে বেইস ধরেই সেটা নির্ধারন হয়।ভারত সেভাবেই বাংলাদেশকে শত্রু রাষ্ট্র মনে করে ডকট্রিন তৈরি করেছে। (১) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এই নিয়ম মেনে সৈনিকেরা প্রশিক্ষিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনীতে।
২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ‘ইন্ডিয়া নট এনিমি ইন বাংলা ওয়ারগেম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। (২) সেখানে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো তার প্রশিক্ষণে পরিবর্তন এনেছে। তিনদিক থেকে ঘিরে রাখা ভারতকে হুমকি বলে মনে করতো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামরিক প্রশিক্ষণে তাই ভারতের হুমকির বিষয়টি মাথায় থাকা অস্বাভাবিক নয়।সেনাবাহিনী মনে করছে, এখন ভারত আর কোনো হুমকি নয়। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা যে যুদ্ধখেলায় (ওয়ারগেম) অংশ নিয়েছেন তাতে ভারত সীমান্তকে হুমকি (ওয়ারফ্রন্ট) বলে বিবেচনা করা হয়নি।
যুদ্ধখেলা সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতে তাদের যুদ্ধের মতবাদ (ডকট্রিন) এবং কৌশল শেখানো হয়। যুদ্ধ খেলায় শত্রুর নাম প্রকাশ করা হয় না। তবে আন্তর্জাতিক সীমান্তের অবস্থান এবং সামরিক বাহিনীর সংখ্যার (ফোর্স লেভেল) ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় প্রতিপক্ষ কে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে। তাই এই যুদ্ধ খেলায় ভারতকে নিশানা করার নীতিতে সংশোধন ভারতের একটি অন্যতম লক্ষ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে দ্বিপাক্ষিক সফরকালে ভারতের সেনাপ্রধান বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করে বলেছিলেন,
‘আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ খেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্তের পরিবর্তে তাদের নিজেদের সীমান্তকে নির্ধারণ করতে বলেছি এবং সৈন্য সংখ্যায় পরিবর্তন আনতে বলেছি, যাতে কাকতালীয়ভাবে তা ভারতকে লক্ষ্যবস্তু না বানায়।’ এই আহ্বানের দু’বছর পর প্রতিরক্ষা বিভাগের নেতৃত্ব এবং স্টাফ কলেজ, যারা নির্বাচিত ঊর্ধ্বতন নেতাদের প্রশিক্ষণ দেয়, এই পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী গঠনের পর এই প্রথম এ ঘটনা ঘটলো।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা (ভারতের) বলেন, ‘আপনার সব মতবাদ (ডকট্রিন) এবং যুদ্ধের হালচাল যদি ভারতকে লক্ষ্য করে হয়, তবে তা প্রতিবেশীকে কিভাবে দেখা হয় তার ওপরে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি করে।’ এক সপ্তাহ ধরে চলা জানুয়ারি ২০১৪ সালের ঐ প্রশিক্ষণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তকে ‘শত্রু’ বিবেচনা করা হয়নি।‘তারা নিজেদের সীমান্তের নকশার ওপর যুদ্ধ খেলায় অংশ নেয় এবং সৈন্য সংখ্যাও অপরিবর্তিত রাখা হয়।’ একজন ভারতীয় সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, এখন সোনালি সময় পার করছি আমরা।’''
এখন তাহলে কিভাবে প্রশিক্ষণ হয়? প্রশিক্ষণটা ডামি শত্রুকে কেন্দ্র করে। এখন কল্পনা করতে শেখানো হয় (উদারহন) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শত্রু গাজীপুর,কুমিল্লার শত্রু ময়মনসিং বা সিলেট।অর্থাৎ, সৈনিকদের মনস্তত্বে প্রকৃত শত্রুর অনুপস্থিত করে প্যারাডাইম সিফট করে দেয়া হয়েছে খুব সুক্ষভাবে। এর স্থলে নিজেদের মধ্যেই শত্রু (খেলার ছলে) খোঁজার প্রশিক্ষণ সৈনিকদের মধ্যে কনফিউশান তৈরির আশংকা থাকে।
বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন একটি স্বীকৃত বিষয়। আমেরিকা-বাংলাদেশ, চীন-ভারত, চীন-পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোর মধ্যে এই ধরণের প্রশিক্ষণ, অনুশীলন হয়। ভারত-বাংলাদেশের সেনাদের মধ্যেও এটা হতে পারে। কিন্তু কোন দেশ যদি আরেক দেশকে বলে দেয় কে তাঁদের বন্ধু বা কেন তাঁদের শত্রু নয়,তাহলে এই বাহিনী দিয়ে নিজের দেশের লোক মারা ছাড়া আর কি হবে?(৩) ২০১০ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ভারত-বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পর্যায়ে 'সম্প্রীতি' প্রশিক্ষণ হয়ে আসছে।
এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে এমন ভাবে তৈরি করার আশংকা হচ্ছে,তারা অন্য সব দেশের জন্য ভাঁড়ায় খাটবে (ইউ এন মিশন) কিন্তু খাটবে না নিজের দেশের জন্য। বাংলাদেশের মানুষের ট্রেক্সের টাকায় প্রশিক্ষিত হয়ে অন্যদেশের মানুষের জীবন রক্ষায় তাঁরা নিয়োজিত থাকবে। কিন্তু নিজের দেশের জন্য, এমনকি নিজের জীবন রক্ষার্থেও তাঁরা দেশের ভেতরে কোন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে বলে মনে হয়না। (৪)
এরই মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়, দেশের বৃহৎ বৃহৎ কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টগুলোর দায়িত্ব তাঁদের দিয়ে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সৈনিকদের মূল যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সেখানে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার আশংকা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে সিমেন্ট বিক্রি, সেতু তৈরি, হোটেল ব্যবসা, ট্যাক্সি সার্ভিস এমনকি ব্যাংক পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ (৫) বাংলাদেশী নাগরিকদের এই প্রশ্ন এখন উঠছে, সেনাবাহিনী দিয়ে যদি ব্যবসাই করা হবে তাহলে দেশরক্ষার দায়িত্ব কে পালন করবে?
নোটঃ
(১) দেখুন, ভারতের কাছে বাংলাদেশ শত্রু রাষ্ট্র
https://www.facebook.com/muldharabd/photos/a.1034347426628580.1073741828.1030910963638893/1457363727660279/?type=3
(২) The New Indian Express, India not ‘Enemy’ in Bangla Wargames, 10th February 2014,
http://www.newindianexpress.com/…/India-not-Enemy-in-Bangla…
(৩) নারায়নগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনে সেনা সদস্যদের ফাঁসির রায় হয়েছে। দেখুন বিস্তারিত; চ্যানেল আই অনলাইন, সাত খুন মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ, ১৬ জানুয়ারী ২০১৭
(৪) উপরের নির্দেশের অভাবে সেনা অফিসারদের খুন হওয়ার উজ্জ্বল প্রমাণ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ।এই বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন; নয়া উপনিবেশের প্রশ্ন;
(৫) আরাফাতুল ইসলাম, সামরিক বাহিনী কি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে?, DW বাংলা, 04.01.2016
https://goo.gl/eKGRi7
প্রাসঙ্গিক পোষ্টঃ
আগের পর্ব- ভারতকে বুঝা-৬ঃ মানচিত্রের মাধ্যমে
পরের পর্বঃ ভারতকে বুঝা-৮ঃ ক্রিটিকাল পর্যালোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক